অনিয়ম রোধে ইতিবাচক পদক্ষেপ
গ্রাহকের ঋণসীমা নির্ধারণ
ব্যাংক খাত অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। সঞ্চয়কে বিনিয়োগে রূপান্তর করে শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের প্রবাহ সচল রাখার দায়িত্ব এ খাতের ওপরই বর্তায়। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, দীর্ঘদিন ধরেই অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থপাচার ব্যাংকব্যবস্থাকে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। প্রভাবশালী গোষ্ঠীর প্রভাব, ঋণ বিতরণে অস্বচ্ছতা এবং খেলাপি ঋণ সংস্কৃতি পুরো অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ঋণ ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম ও দুর্নীতিই এর অন্যতম কারণ। জবাবদিহির ঘাটতি ঋণব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে। এতদিন একজন ঋণগ্রহীতা কোন ব্যাংক থেকে কত ঋণ পাবেন তার সীমা নির্ধারিত থাকলেও একাধিক ব্যাংক থেকে কী পরিমাণ ঋণ নিতে পারবেন, তার সুস্পষ্ট বিধান ছিল না। ফলে অনেক সময় একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে ঋণ কেন্দ্রীভূতকরণ ও খেলাপির ঝুঁকি তৈরি করতেন। এ বাস্তবতা থেকে উত্তরণের জন্য এবার সব ব্যাংক মিলে একজন ঋণগ্রহীতার মোট ঋণের সীমা নির্ধারণে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
যেহেতু গ্রাহক কতগুলো ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবে, তার কোনো সীমা ছিল না। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক বড় গ্রাহক নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এসব ঋণ ব্যবসায় না খাটিয়ে জমি কেনা, অন্য খাতে সরানো কিংবা বিদেশে পাচার করেছে। ফলে ব্যাংক খাত দুর্বল হয়ে পড়েছে, খেলাপি ঋণ বেড়েছে, ফলে সাধারণ আমানতকারীর টাকাও ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, একজন গ্রাহক মোট কত ঋণ নিতে পারবে, তা তার আর্থিক সক্ষমতা, নিট সম্পদ বা লিভারেজ রেশিও দেখে নির্ধারণ করা হবে। বিশ্বের অনেক দেশেই এই ব্যবস্থা আছে। ফলে গ্রাহক তার সামর্থ্যরে বাইরে ঋণ নিতে পারবে না। এটা কার্যকর হলে একই প্রকল্প দেখিয়ে আলাদা আলাদা ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হবে। আবার একটি উদ্দেশ্যে ঋণ নিয়ে অন্য কাজে ব্যবহার করার প্রবণতাও কমে আসবে। সবচেয়ে বড় কথা, এতে খেলাপি ঋণের ঝুঁকি কিছুটা হলেও কমবে বলে আশা করা যায়।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
শুধু নিয়ম বানালেই হবে না, কার্যকরভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন হবে একটি শক্তিশালী ক্রেডিট রেজিস্ট্রি, যেখানে একজন গ্রাহকের সব ঋণের তথ্য থাকবে এবং ব্যাংকগুলো সহজেই তা যাচাই করতে পারবে। পাশাপাশি ঝুঁকি মূল্যায়ন, জামানতের সঠিক হিসাব, বড় ঋণের অনুমোদনে স্বচ্ছতাÑ সবকিছুতে কঠোরতা আনতে হবে। অনেক সময় রাজনৈতিক চাপ, প্রভাবশালী গ্রাহকের লেনদেন সুবিধা কিংবা ব্যাংক পরিচালকদের অনিয়মের কারণে নিয়ম ভাঙা হয়। এগুলো ঠেকাতে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
ঋণ অবলেপনÑ এই জমজমাট অনুশীলনও বড় সমস্যা। অনেক ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে কিছু ঋণ অবলেপন করা হয়। এটা বন্ধ করতে হবে। সম্পূর্ণ খতিয়ে দেখা উচিত কে, কেন ও কী শর্তে ঋণ মুছে দিয়েছে; অনিয়ম থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা ও গ্রাহকের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত ও আইনি ব্যবস্থা নিতে হবেÑ না হলে ভবিষ্যতেও একই কৌশলের পুনরাবৃতি হবে।
আরেকটা বিষয় মনে রাখতে হবেÑ অতীতে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে বা ঋণের টাকা ভিন্ন খাতে সরিয়ে ফেলেছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা চালাতে হবে। পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। এই টাকা ফেরত আনা গেলে ব্যাংক খাত অনেকটা স্বস্তি পাবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
আমরা মনে করি ব্যাংক খাতের সংস্কার এখন আর সময়ক্ষেপণের বিষয় নয়। শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে দুর্নীতিবাজ গ্রাহক ও কর্মকর্তাদের। একই সঙ্গে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণপ্রবাহ খোলা রাখতে হবে, যাতে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
সবশেষে বলা যায়, ব্যাংক খাতকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে হলে কঠোরতা, স্বচ্ছতা আর ন্যায়বিচার একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নিয়ম ভাঙলে যেন কেউ ছাড় না পায়। আর যারা লুটপাট করে দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে এবং পাচার হওয়া টাকাও ফিরিয়ে আনতে হবে। এভাবেই কেবল ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফেরানো সম্ভব, আর তখন জনগণের আস্থাও ফিরে আসবে।
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২