পাহাড়ে রক্তক্ষরণ /
দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিন
পাহাড়ের সাম্প্রতিক সহিংসতা আমাদের সামনে আবারও এক নির্মম বাস্তবতা তুলে ধরেছে। ন্যায়বিচারের অনুপস্থিতি এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি অবহেলা ভয়াবহ পরিস্থিতি ডেকে আনতে পারে। একজন পাহাড়ি কিশোরীর ওপর সংঘটিত দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগের সূত্র ধরে যে আন্দোলন ও বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তা এত দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে- সেটি অনুমান করা কঠিন ছিল না। কারণ আমরা জানি, যেখানে মানুষ ন্যায়বিচার পায় না, তখন রাজপথই তাদের ভরসাস্থল।
প্রশাসনের অদূরদর্শিতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফিলতি পরিস্থিতি এতদূর ঠেলে দিয়েছে। ঘটনার শুরু থেকেই যদি তৎপরতা দেখানো হতো, তবে বিষয়টি এত বড় আকার নেওয়ার কথা ছিল না। একজন অভিযুক্তকে সেনাবাহিনীর সহায়তায় গ্রেপ্তার করা গেলেও গোটা প্রক্রিয়াটি ছিল ধীরগতি ও সীমাবদ্ধ। ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত অপরিহার্য। এটি শুধু ভুক্তভোগীর জন্য ন্যায় প্রতিষ্ঠা নয়, বরং জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনার অন্যতম উপায়। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখেছি, বিলম্বিত পদক্ষেপ এবং অনিশ্চয়তার কারণে মানুষের ক্ষোভ বিক্ষোভে রূপ নিয়েছে, আর সেই বিক্ষোভ পরে সহিংসতা ডেকে এনেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি ও ১৪৪ ধারা জারির মাধ্যমে সাময়িক নিয়ন্ত্রণ আনা গেলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। প্রশাসনের উচিত ছিল মানুষের কাছে স্পষ্টভাবে জানানো যে, অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে, তদন্ত প্রক্রিয়া স্বচ্ছ এবং কোনো মহল তা বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এমন বার্তা পৌঁছায়নি।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
এই ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দেয়, আমাদের সমাজে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীই নির্যাতনের শিকার হয় বেশি। তারা ন্যায়বিচারের আশায় পুলিশের দ্বারস্থ হলে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়, মামলা করতে গেলে টাকা লাগে, সাক্ষ্য দিতে গেলে নিরাপত্তার অভাব থাকে, আর বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতায় আটকে যায়। ফলে তারা সহজেই বঞ্চিত, নির্যাতিত ও নিঃস্ব হয়। পাহাড়ের মতো অঞ্চলে এই বঞ্চনা আরও প্রকট, কারণ প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহলের প্রভাব সেখানে সব সময় কাজ করে। অথচ রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল সবচেয়ে দুর্বলদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
রামেসু বাজারে অর্ধশতাধিক দোকান পুড়িয়ে দেওয়া, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, প্রাণহানি- এসব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা কেবল দোকান বা ঘর হারাননি, বরং হারিয়েছেন জীবিকা, স্বপ্ন ও নিরাপত্তাবোধ। প্রশাসনের এখন জরুরি দায়িত্ব হলো দ্রুত ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা, তাদের জন্য আর্থিক ও মানবিক সহায়তার ব্যবস্থা করা, এবং এ ধরনের সহিংসতার পুনরাবৃত্তি রোধে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের সমাজে বারবার অপরাধের ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা হয়। অন্য পক্ষের ইন্ধন আছে কিনা, বিদেশি ষড়যন্ত্র আছে কিনা এসব নিয়ে জল্পনা করা মূল বিষয়কে আড়াল করে ফেলে। এতে শুধু প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। এই আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র বলে খাটো করার প্রবণতা ভুক্তভোগীদের আরও অসহায় করে তোলে এবং অপরাধীদের উৎসাহিত করে। রাষ্ট্র ও প্রশাসনের উচিত ছিল প্রথম দিন থেকেই স্পষ্ট করে বলা- এটি একটি অপরাধ, এর বিচার হবেই, কোনোভাবেই অপরাধী পার পাবে না।
আমরা বিশ্বাস করি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি দায়িত্বশীলতা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে, তবে আসামি ধরতে বা অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তাদের অপরাধী শনাক্তকরণ ও গ্রেপ্তারের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু সেই সক্ষমতা প্রয়োগে গাফিলতি, অবহেলা এবং প্রভাবশালীদের প্রতি নরম মনোভাবই পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে। এর ফল ভোগ করে সাধারণ মানুষ।
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২
আর কালক্ষেপণ নয়, আমরা দ্রুত ধর্ষণকারীদের আইনের আওতায় এনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানাই। আমরা চাই- যাদের গুলিতে তিন পাহাড়ি প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হোক।