সদ্ব্যবহার হওয়া জরুরি

রেমিট্যান্স প্রবাহ

সম্পাদকীয়
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সদ্ব্যবহার হওয়া জরুরি

ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও বিনিয়োগে অনীহার কারণে দেশীয় অর্থনীতি বড় ধাক্কা খেয়েছিল। জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর সাময়িক সময়ের জন্য অর্থনীতির চাকা যেন থমকে যায়। এ সময়ে ভরসার জায়গা হয়ে ওঠে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স। গত শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ‘এনআরবি কানেক্ট ডে : এমপাওয়ারিং গ্লোবাল বাংলাদেশিজ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রবাসীদের এই অবদানের প্রশংসা করেন। তিনি যথার্থই বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার প্রধান চালিকা শক্তি এখন রেমিট্যান্স।

প্রবাসীরা শুধু অর্থ পাঠাচ্ছেন না; তাঁরা দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ ও আত্মত্যাগের নজিরও সৃষ্টি করছেন। তাদের উপার্জিত অর্থ প্রতিদিন গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখছে, লাখো পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শুধু জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়েই ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে এসেছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলায় অক্সিজেন হিসেবে কাজ করছে।

শুধু রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভর করে টেকসই অর্থনীতি গড়া সম্ভব নয়। প্রবাসীদের এই অবদানকে সম্মান জানাতে হলে, দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে, প্রবাসীদের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে হবেÑ এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতার ঘাটতি, অনিয়ম ও দুর্বল নীতিমালা বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করেছে। প্রবাসীরা যদি নিশ্চিত হন যে তাঁদের অর্থ নিরাপদ থাকবে এবং সঠিকভাবে ব্যবহার হবে, তাহলে তারাই সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী হয়ে উঠতে পারেন। এটি বৈদেশিক ঋণ নির্ভরতা কমাবে এবং দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করবে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স যে বিপুল প্রভাব ফেলছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বাড়ি নির্মাণ, কৃষিতে বিনিয়োগ, ছোট ব্যবসা শুরু, সন্তানদের পড়াশোনা কিংবা চিকিৎসা, সব ক্ষেত্রেই প্রবাসীদের পাঠানো অর্থই প্রধান চালিকা শক্তি। এর বাইরে এ অর্থকে যদি জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতে আনা যায়, তাহলে অর্থনীতির চিত্র পাল্টে যাবে। উদাহরণস্বরূপ মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপ-আমেরিকায় কর্মরত প্রবাসীদের মধ্যে অনেকেই ব্যবসায় আগ্রহী। তাঁদের জন্য দেশে সহজ শর্তে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগ প্রকল্পে অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে যেমন কর্মসংস্থান বাড়বে, তেমনি টেকসই উন্নয়নও সম্ভব হবে।

দীর্ঘদিন ধরে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে। শুধু প্রবাসী নয়, দেশীয় উদ্যোক্তারাও প্রায়ই এসব কারণে হতাশ হন। সুতরাং দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হলে সবার আগে দুর্নীতির দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে। প্রশাসনকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। ব্যবসা সহজীকরণে কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করার মতো স্বচ্ছ নীতিমালা ও স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।

তা ছাড়া প্রবাসী আয় যেন কেবল ভোগে সীমাবদ্ধ না থেকে উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হয়, সেই সচেতনতা গড়ে তোলাও প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকার যেমন নীতিগত সহায়তা দিতে পারে, তেমনি সামাজিক সংগঠন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে প্রবাসীরা যাতে সহজে দেশে বিনিয়োগ করতে পারেন, সে সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রবাসী শ্রমিকদের একটি বড় অংশ অদক্ষ বা অল্প দক্ষ। তারা উন্নত দেশগুলোতে গিয়ে স্বল্প আয়ের কাজ করেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ভাষাগত দক্ষতা না থাকার কারণে তারা প্রায়ই নানা ভোগান্তি, শোষণ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েন। অথচ সামান্য প্রযুক্তিগত ও কারিগরি প্রশিক্ষণ থাকলে তাদের আয় কয়েকগুণ বাড়তে পারে। তাই সরকারের একটি জরুরি উদ্যোগ হওয়া উচিত দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে আন্তর্জাতিক মানে গড়ে তোলা। বিমানবন্দরে হয়রানি কমানো, নিরাপদ শ্রম অভিবাসন নিশ্চিত করা এবং অভিবাসী কল্যাণ তহবিলকে স্বচ্ছ ও কার্যকর করা এখন সময়ের দাবি।

সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ যে আজও অর্থনৈতিকভাবে টিকে আছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ প্রবাসী বাংলাদেশিরা। তাঁদের রেমিট্যান্স কেবল অর্থনৈতিক ভিত্তি নয়, দেশের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য আবেগের বন্ধনও গড়ে তুলেছে। তাই তাদের অবদানকে শুধু প্রশংসা করলেই হবে না, প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও নিরাপদ বিনিয়োগের সুযোগও প্রদান করা জরুরি।