চাই প্রাণের স্পন্দন

সম্পাদকীয়
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৩:৫২
শেয়ার :
চাই প্রাণের স্পন্দন

বিশ্ব নদী দিবস এলেই ঘটা করে সভা-সেমিনারে নদীর কথা বলা হয়, দেওয়া হয় প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি। অথচ বাস্তব চিত্র চরম হতাশাজনক- দেশের নদীগুলো নিঃশব্দে মরছে দখল, দূষণ আর উদাসীনতায়। কাগজে-কলমে ১ হাজার ৪১৫টি নদীর হিসাব থাকলেও বাস্তবে অর্ধেকের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে গেছে। নীতিনির্ধারকরা বরাবরের মতো মুখে নদী বাঁচানোর কথা বলেন; কিন্তু কাজের মাঠে নেমে কিছুই করেন না। নদী রক্ষা দিবস কেবল হয়ে দাঁড়িয়েছে আনুষ্ঠানিকতাসর্বস্ব। নদী রক্ষায় কোনো কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দৃশ্যমান নয়। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী না থাকলে আমাদের অস্তিত্বও থাকবে না। বাংলাদেশের অস্তিত্ব, জীববৈচিত্র্য, কৃষি এবং মানুষের জীবনধারা- সবই নদীনির্ভর। কাজেই নদী রক্ষা মানে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের হিসাব অনুযায়ী দেশে ৫৭ হাজারেরও বেশি অবৈধ দখলদারের তালিকা করা হয়েছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে অভিযান চললেও পুনর্দখলের চক্র ভাঙা যায়নি। সরকার বদলায়; কিন্তু দখলদারদের প্রতাপ কমে না। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও সরকারি সংস্থার সংশ্লিষ্টতায় নদী রক্ষা কার্যক্রম বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা স্পষ্টভাবে বলছেন- দখলদার সিন্ডিকেট ভয়ঙ্কর। সরকারের মধ্যে সদিচ্ছার অভাব আছে। নদী রক্ষা নিয়ে বারবার উদ্যোগ শুরু হয়ে মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে এই সদিচ্ছার ঘাটতি ও রাজনৈতিক স্বার্থের জটিলতা স্পষ্ট। অথচ নদী বাঁচানো মানে দেশ বাঁচানো। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের মাতে, বাংলাদেশের নদী বিপর্যয়ের মূল কারণ তিনটি- ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার, দেশের অভ্যন্তরে নদীবিধ্বংসী উন্নয়ন প্রকল্প এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দখল ও দূষণ। ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিন আলোচনা চললেও কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশনে স্বাক্ষর না করায় ভারত বহুপক্ষীয় আলোচনা এড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশ এককভাবে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর প্রতিবাদে কূটনৈতিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে জোরালো অবস্থান নেওয়া জরুরি।

অভ্যন্তরীণ দিকেও নদীবিধ্বংসী কার্যক্রমের কোনো কমতি নেই। চলনবিলে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের উদ্যোগ তারই একটি দৃষ্টান্ত, যেখানে প্রাকৃতিক জলাভূমি ধ্বংস করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। এটি কেবল অজ্ঞতা নয়, এর পেছনে ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্বার্থও কাজ করে বলে ধারণা করা যায়।

নদী রক্ষার লড়াই শুধু পরিবেশবাদী কিংবা বিশেষজ্ঞদের নয়; এটি গোটা জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন। যদি এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়া হয়; তবে কৃষি, মৎস্য, নৌপরিবহন থেকে শুরু করে পুরো অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে।

আমরা মনে করি, নদী রক্ষায় কিছু জরুরি পদক্ষেপ অবিলম্বে নেওয়া প্রয়োজন। সব নদী ও খালের পূর্ণাঙ্গ ও হালনাগাদ জরিপ করে মানচিত্র প্রকাশ করতে হবে। অবৈধ দখলদারদের স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করে নদী কমিশনকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। আর আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টনে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করতে হবে। সেজন্য সরকারকে অবশ্যই আন্তরিকতার সঙ্গে নদী দখল ও দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। পাশাপাশি নদী কমিশনের কার্যক্রমকে আরও স্বাধীন, শক্তিশালী ও স্বচ্ছ করতে হবে। শুধু তালিকা প্রকাশ নয়, দখলদারদের বিরুদ্ধে দ্রুত এবং দৃশ্যমান শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে মেনে নিয়ে তাতে হস্তক্ষেপকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

মনে রাখতে হবে- দেশের নদ-নদী শুধু পানিপ্রবাহ নয়, এটি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, জীবন ও জীবিকার অংশ। সেগুলো রক্ষা করা মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করা। এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে শুধু সরকার নয়; নাগরিক সমাজ, পরিবেশবাদী সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং প্রতিটি সচেতন নাগরিকের এগিয়ে আসা দরকার।