ধর্ষণের বিচারে বরফ-পানি খেলা
বাংলাদেশে প্রতিদিনই ঘটছে নানা ধরনের মন খারাপ করা, রাগে ফুঁসে ওঠা কিংবা লাগাতার বিরক্তি তৈরি করার ঘটনা। অনেকেই যুক্ত দিচ্ছেন যে, একটি গণ-অভ্যুত্থানের পর একটি দেশে এমন অবস্থা হতেই পারে। কিন্তু আপাতভাবে মনে হচ্ছে, এ ধরনের যুক্তি এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনাগুলোর পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে এবং সমর্থন লাভ করছে। এই প্রবণতা সমতল এবং পাহাড়ে সমানভাবেই এগিয়ে চলছে। বিচার তো দূরের কথা, জায়গাবিশেষে জনগণ ভয়ে বিচার চাইতেও পারছে না।
পার্বত্য এলাকা খাগড়াছড়িতে চলছে প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ আমরা ঢাকায়ও দেখতে পাচ্ছি। এই প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, অবরোধ চলমান থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে আদিবাসী প্রতিবাদী জনতা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, গত মঙ্গলবার খাগড়াছড়ির সদর উপজেলায় মারমা এক কিশোরীকে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয় এবং রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় উপজেলার একটি গ্রামের ক্ষেত থেকে তাকে উদ্ধার করে তার পরিবারের সদস্যরা। মামলাও হয়েছে। এই ধর্ষণের বিচার চেয়ে ফেটে পড়ছে বিক্ষুব্ধ জনগণ। গত জুন মাসেও খাগড়াছড়িতে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। সেই মেয়েটি মানসিকভাবে এতই নাজুক হয়ে পড়েছিল যে সে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ডয়চে ভেলে ২৫ সেপ্টেম্বর তাদের প্রকাশিত সংবাদে খাগড়াছড়ির মহিলা কল্যাণ সমিতির বরাতে বলছে, গত এক বছরে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে ধর্ষণের শিকার হয়েছে সাতজন আদিবাসী নারী। এর পাশাপাশি ঘটেছে ধর্ষণের চেষ্টাও। এই এক বছরে ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে তিনটি। সেখানে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাই বেশি ঘটছে।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান কাপেং ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ২৯৯ জন আদিবাসী নারী ধর্ষণ ও অপহরণের শিকার হয়েছে। তবে এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, এই হিসাবের ভিত্তি শুধু বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রকাশিত সংবাদ। তার মানে হলো, এই সংখ্যা অনেক বেশি। কারণ প্রথমত সব ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিচার চেয়ে অভিযোগ থানা পর্যন্ত আসে না কিংবা আসতে দেওয়া হয় না। কারও কারও পরিবার সমাজের ভয়ে চেপে যায়, কারও কারও থানা-পুলিশ করার আর্থিক সংগতি থাকে না, আবার ভয়েও অনেকে এর বিচার চাইতে পারে না। তাই ধরেই নেওয়া যায় যে, অনেক ধর্ষণ এবং নিপীড়নের ঘটনা আড়ালে থেকে যায়। দ্বিতীয়ত, সব মামলার খবরই যে গণমাধ্যমে আসে তা নয়। তাই যেসব খবর আমরা পাই সেটি অনেকটাই অল্প-স্বল্প। আর বাকিগুলো বিচার চাওয়ার রাস্তা থেকেই গায়েব হয়ে যায়।
পরিবার ও সমাজের বাইরেও এ ধরনের ঘটনায় কেন ধর্ষণের শিকার নারী কিংবা তার পরিবার মামলা করতে চায় না? বাংলাদেশে ধর্ষণ মামলা জামিযোগ্য না হলেও আসামি এ ধরনের মামলায় খুব দ্রুতই জামিন পেয়ে যায়। আর জামিন পেয়েই প্রথম টার্গেট থাকে সেই মেয়ে এবং তার পরিবারের ক্ষতি করা। এবং এ ধরনের মামলা অনেক সময় যুগের পর যুগ চলতে থাকে। পরিবারের পক্ষে এটি দীর্ঘদিন টেনে নেওয়া সম্ভব হয় না। আর পাহাড়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয় যায় জাতিগত ও ধর্মীয় অনুষঙ্গ। তাই বিচার যে আরও কঠিন সেটি আদিবাসীরা এতদিনে জেনে গেছে।
অনেকেই হয়তো এই যুক্তি দিয়ে কথা বলবেন যে, ধর্ষণ তো বাংলাদেশের সব জায়গাতেই ঘটে, তাহলে পাহাড়ে নারী ধর্ষণকে কেন আলাদা করে আমলে নিতে হবে? নিতে হবে এ কারণেই যে, ক্ষমতাকাঠামোতে পাহাড়ের নারীরা কোথায় রয়েছে? সেখানে নারীর বিপক্ষে কোন কোন শক্তি কাজ করছে? আরও প্রশ্ন আসতে পারে, যেমন- ধর্ষণ তো ধর্ষণই। গণধর্ষণকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে দেখার কী আছে?
এসব প্রশ্ন মনে এলে প্রথমে নিজেকেই প্রশ্ন করুন, পাহাড়ে কেন গণধর্ষণ বেশি হয়? এটি কি তবে কেবল জাতিগত দেমাগিপনা, হিংসা, ঘৃণা কিংবা বিদ্বেষজনিত প্রতিশোধ? নাকি পাহাড়ের নারী নিপীড়নের বিচার খুব বেশি এগোবে না ভেবেই এ ধরনের নানামুখী শক্তির প্রয়োগ? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেল দেখতে হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গে আদিবাসী নারীর সম্পর্ক কেমন সেই বিষয়টি। এখানে স্পষ্টতই বলে রাখা প্রয়োজন, ওই আদিবাসী নারীর নাচ আর পাহাড়ের ‘সৌন্দর্য’ দিয়ে পর্যটকদের আগ্রহ তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী নিপীড়নের ঐতিহাসিকতা সমতল থেকে কিছুটা ভিন্ন। যদিও ‘আদিবাসী নারীও’ কোনো সমগোত্রীয় ক্যাটাগরি নয়। কিন্তু এই আদিবাসী নারীরা নারী হিসেবে, জাতিগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে, অর্থনৈতিক মানদণ্ডে অপেক্ষাকৃত নিচে থাকায় তাদের নিপীড়ন করা সব অর্থেই সংখ্যাগুরুর জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ। আর সেটি যদি অনেকে মিলে করে তাহলে তাদের শক্ত অবস্থান আরও বেশি শক্ত হয়। সেখানে আসামি যখন অনেক হয় তখন এত এত আধিপত্যের বহুজনীয় ক্ষমতাকে ভেঙে বিচার পাওয়া খুব কঠিন হয়। এবং আদিবাসী নারীর জন্য যে সেটি আরও কঠিন এটা এতদিনের অভিজ্ঞতায় সবাই বুঝে গেছে। তাই ধর্ষকরাও এই বাস্তবতার সুযোগ খোঁজে এবং সেটিকে কাজে লাগায়। এ কারণেই পাহাড়ে গণধর্ষণের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।
খুব গুরুত্বপূর্ণ আলাপ হলো, নারী নিপীড়নের প্রতিবাদের ক্ষেত্রে কী কী বৈশিষ্ট্য আমরা পর্যবেক্ষণ করি? সাধারণত যেকোনো নারী নিপীড়নের ঘটনাতেই নারীরাই প্রথমে প্রতিবাদ করে এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ধরেই নেয় যে, নারী ইস্যুতে নারীরাই প্রতিবাদ করবে। ঠিক একইভাবে যখন পাহাড় কিংবা সমতলে আদিবাসী নারী ধর্ষণ কিংবা অন?্যান?্য ধরনের নিপীড়নের শিকার হয়, তখন বেশির ভাগ সময়ই বাঙালি সমাজ ধরেই নেয় যে, এটি আদিবাসী নারীর ইসু্যু এবং আদিবাসীরাই এর প্রতিবাদ করবে। তাই সামগ্রিক অর্থে এটি নারী আন্দোলনের প্রতিবাদ হিসেবে জায়গা পায় না।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বহুত্ববাদ টার্মটি আলোচনার টেবিলে এসেছিল। কিন্তু এখন সেটি অনেক দূরে। বিশেষ করে পাঠ্যপুস্তক থেকে আদিবাসী লেখা পাতাসহ গাছের গ্রাফিতি তুলে নিল সরকার। তবে সেটি করতে খুব বেশি জোরালো প্রতিবাদ করতে হয়নি। হঠাৎ তৈরি হওয়া একটি সংগঠনের অল্প কিছু আওয়াজেই সেটি সরকার তুলে দিল। সেই যে চলে গেল বহুত্ববাদিতার কাক্সিক্ষত স্বপ্ন, আর কোথাও দেখা যায়নি। বরং আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতির আকাক্সক্ষার বিপরীতে সরকারি দিক থেকে সেই দাবিতে সাড়া না দেওয়ার মানসিকতা বারবার স্মরণ করিয়ে দিল এবং দিচ্ছে যে, এই সরকারেরও এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই।
তাই পার্বত্য অঞ্চলে যে কোনো ধর্ষণ কিংবা নিপীড়নের ঘটনাই ঘটুক না কেন সে বিষয়ে খুব আগ্রহ কারোরই নেই। কারণ এখানেও শক্তিশালীভাবে কাজ করছে ‘আমরা’-‘তারা’ রাজনীতি। যদিও এই ধর্ষণের ঘটনায় পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে বলে গণমাধ্যম সূত্র জানা গেছে, কিন্তু সবাই জানে যে, এই আসামি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জামিন পেয়ে যাবে। কারণ এর আগের ধর্ষণ ঘটনায়ও আসামি অল্প কয়েকদিনের মধ্যে জামিন পেয়ে গেছে এবং উল্টো ভয় দেখাচ্ছে ধর্ষণের শিকার নারীকে।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশে চর্চিত একটি বিষয়। এখন সেটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিচার না চাওয়ার সংস্কৃতি। চারদিকে মবের দৌরাত্ম, হচ্ছে ভাঙচুর, চলছে নানামুখী নিষেধাজ্ঞা। এসবের মধ্যে ধর্ষণের মতো ঘটনার বিচার চাওয়াও রীতিমতো দুরূহ কাজ। আর সরকারের মনোযোগও নেই বিচারের জায়গাটিকে শক্ত করায়। সরকারের আসল মনোযোগ যে কোথায় এই এক বছরের বেশি সময়ে জনগণ বুঝে নিয়েছে। কিছু গ্রেপ্তার আর কিছুদিন পরেই জামিন দেওয়ার মতো এই ‘বরফ-পানি’ খেলা বন্ধ করতে না পারলে বন্ধ হবে না ধর্ষণের মতো ঘটনাও। সেটি যে সহসাই ঘটবে না, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কারণ ঘটনা তো ঘটেছে পাহাড়ে, তাতে আমাদের কী!
ড. জোবাইদা নাসরীন : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়
আরও পড়ুন:
মার্কিন শ্রমনীতি দেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য?
মতামত লেখকের নিজস্ব