নদী বাঁচলে বাঁচবে দেশ

ড. কামরুজ্জামান
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:৫৩
শেয়ার :
নদী বাঁচলে বাঁচবে দেশ

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এ দেশের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে অসংখ্য নদ-নদী। কবি ও সাহিত্যিকের ভাষায় এ দেশ তেরশত নদীর দেশ। বই-পুস্তকে সাতশ নদ-নদীর কথা রয়েছে। আর বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবহমান নদ-নদীর সংখ্যা রয়েছে প্রায় ২৩০। বাংলাদেশের অবস্থান হিমালয় পর্বতের পাদদেশে হওয়ায় এবং ব্রহ্মপুত্র, পদ্মাসহ অনেক নদ-নদীর উৎপত্তিস্থল হিমালয় পর্বতে হওয়ায় বাংলাদেশকে ভৌগোলিকভাবে ভাটির দেশ বলা হয়। নদীবাহিত পলি বালু দ্বারা গঠিত বাংলাদেশ মূলত প্লাবন ভূমির দেশ। বাংলাদেশের সব নদ-নদীর মিলনস্থল হচ্ছে বঙ্গোপসাগর।

বাংলাদেশের রূপবৈচিত্র্যময়তাকে আরও বেশি আকর্ষণীয় এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আঁকাবাকা সর্পিল গতির নদ-নদীগুলো। নদীর চলার গতিতে যেমন ছন্দ খুঁজে পাওয়া যায় তেমনি শ্রুতিমধুর নদীর নামগুলোও আমাদের মুগ্ধ করে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী, ব্রহ্মপুত্র, বানার, পারুলি, চিলাই, কীর্তনখোলা, বুড়িগঙ্গা, ধানসিড়ি, সুগন্ধা, পিয়াইন, মাতামুহুরী, সাঙ্গু, চিত্রা, করতোয়া, হালদা, মহানন্দা, ডাহুক ইত্যাদি নদ-নদী যেন আমাদের প্রাণের তৃষ্ণা মেটায়, হৃদয়ের কথা বলে।

৬৪টি জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো সমভূমি পথ পাড়ি দিয়ে সর্পিল গতিতে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। বাংলাদেশের ভূমিরূপকে প্রধাণত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। এক. প্লাইস্টোসিন চত্বর (মধুপুর ও ভাওয়ালের গড়, লালমাই পাহাড় ও বরেন্দ্রভূমি) দুই. টারশিয়ারি যুগের পাহাড়সমূহ (দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়িয়া এলাকা) তিন. নদীবাহিত পলল গঠিত সমভূমি, যা বাংলাদেশের ভূমিরূপের অন্যতম ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের ভূমিরূপ মূলত নদীবাহিত পলিবালু দ্বারা গঠিত। ভূমিরূপ গঠনসহ এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহে নদ-নদীর অবদান অনস্বীকার্য বলা যায়।

একটা সময় বাংলাদেশের নদ-নদীতে প্রচুর পরিমাণে দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। একশ্রেণির মানুষ মাছ আহরণ ও মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত। বাংলাদেশের মানুষও তিন বেলা খাবারে সহজ উপাদেয় খাদ্য হিসেবে মাছ গ্রহণ করত। এ জন্য একটা সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষকে বলা হতো ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। এখনও দেশের অভ্যন্তরীণ মাছের প্রধান উৎস হচ্ছে নদ-নদী। এর বাইরেও ব্যবসা-বাণিজ্য ও লোকজ সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে আমাদের নদ-নদী ও খালবিল।

আমাদের দেশে নদীকে কেন্দ্র করে অসংখ্য হাটবাজার গড়ে উঠেছে। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে নদীবন্দর। বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এবং রাজধানী শহর ঢাকার সঙ্গে মালপত্র পরিবহন ও যাত্রীসাধারণের আসা-যাওয়াও করা হয় নৌপথ দিয়ে। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ রক্ষা হয় নৌপথ দিয়েই। যদিও বর্তমানে পদ্মা সেতু হওয়ায় নদীপথ কিছুটা সংকুচিত হয়েছে।

নদীকেন্দ্রিক হাটবাজারে তৃণমূল পর্যায়ের প্রান্তিক কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য বেচাকেনা হয়ে থাকে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের ব্যবসায়ীরা এসব পণ্য ক্রয় করে নদীপথেই অন্যত্র বা ঢাকা শহরে নিয়ে যান। যদিও এখন সড়কপথে বেশির ভাগ পণ্য আনা-নেওয়া করা হয়, তার পরও নদীপথের গুরুত্ব অপরিসীম।

বাংলাদেশের নদী, মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নদীর গান, মাঝির গান, যাত্রাপালা, লোকজ সংস্কৃতির বিভিন্ন উৎসব পালাগান, জারিগান, ভাটিয়ালি ও ভাওয়াইয়া, লালনগীতি, হাছন রাজা, শাহ আব্দুল করিমের লোকজ গানসহ অসংখ্য শিল্প ও সাহিত্যের বিশাল সমৃদ্ধ ভাণ্ডার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আমাদের নদ-নদীকে কেন্দ্র করে।

আমাদের দেশের নদ-নদীর জীবন ও কাহিনি নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস। তৈরি হয়েছে অসংখ্য কবি ও সাহিত্যিক। কবি ও সাহিত্যিকের কবিতা ও লেখায় অসংখ্য নদ-নদীর রূপবৈচিত্র্য ও বর্ণনা পাওয়া যায়। কবি জীবনানন্দ দাশ রূপবৈচিত্র্যে ভরপুর বাংলাদেশকে রূপসী বাংলার দেশ বলেছেন। তার লেখায় ধানসিড়ি নদীর সৌন্দর্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান চিত্রা নদীর পাড়ে গড়ে তুলেছেন তার শিশু স্বর্গ।

কৃষিজমির পানির প্রধান উৎস হচ্ছে নদী, খাল ও প্রাকৃতিক জলাশয়। বাংলাদেশের কৃষিজমিতে নিরবচ্ছিন্ন সেচব্যবস্থার জন্য নদীকে কেন্দ্র করে বড় বড় কৃষি সেচ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প হচ্ছে তিস্তা সেচ প্রকল্প। গঙ্গা- কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প, মাতামুহুরী সেচ প্রকল্প ইত্যাদি। নদীভিত্তিক এসব প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে জমিতে পানি সরবরাহ ঠিক রেখে ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করা। বিশাল জনসংখ্যার এই দেশে নদ-নদীর এ রকম অপার প্রাকৃতিক সুবিধার কারণেই কৃষি ফসল উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। নদ-নদীকে বাংলাদেশের প্রকৃতির দানও বলা যায়।

এ দেশের নদ-নদীর আশীর্বাদের কথা বলে শেষ করা যাবে না। নির্মাণশিল্পের সব ধরনের বালুর উৎস হচ্ছে আমাদের নদ-নদী। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলের নদ-নদী থেকে সাধারণ মানের বালু, মোটা দানার বালু ও সিলেকশন বালু সবই পাওয়া যায়। এ ছাড়াও রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর নির্মাণের জন্য যেসব পাথর প্রয়োজন হয় তার সবই সংগ্রহ করা হয় নদ-নদী থেকে। সিলেটের পিয়াইন নদী, নেত্রকোনা জেলার সোমেশ্বরী নদীসহ অনেক নদী থেকেই মূল্যবান এই সম্পদ পাওয়া যায়। 

আমাদের নদীর গুণকীর্তন বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছেÑ আজ আমাদের দেশের নদ-নদীগুলো দূষণ ও দখলে নিমজ্জিত। এমন কোনো নদী খুঁজে পাওয়া যাবে না যেটা আজ দূষণ ও দখলে পড়েনি। মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও লোলুপ দৃষ্টি নদ-নদীগুলোর স্বাভাবিক চলার পথকে করছে বাধাগ্রস্ত। এবং এর প্রভাব পড়ছে মানবজীবনে ও প্রাকৃতিক পরিবেশে। নদ-নদীগুলো কেন দখল ও দূষণ হচ্ছে তা গভীরভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন।

একটি দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে শিল্পায়ন। বাংলাদেশ শিল্পে উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু কাক্সিক্ষত পর্যায়ে এখনও পৌঁছাতে পারেনি। যতটুকু শিল্পায়ন হয়েছে তারও আবার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর। বিশেষ করে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ জেলার নদ-নদী আজ মারাত্মক রকমের দূষণের কবলে পড়েছে। এ ছাড়া কুমিল্লা, চট্টগ্রাম সিলেট ও অন্যান্য বিভাগীয় জেলাশহরের নদীগুলোও দূষণের কবলে রয়েছে। 

নদী দখল ও নাব্যতা সংকট এর মধ্যে অন্যতম। প্রধান নদ-নদী গুলোÑ যেমন : পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী, সুরমা, তিস্তা, ধলেশ্বরী, মাতামুহুরী, বুড়িগঙ্গা, কীর্তনখোলা, গাজীপুরে তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, চিলাই নদী ও পারুলী ইত্যাদি নদী আজ দখল এবং নাব্যতা সংকটেও ভুগছে।

নদ-নদীতে অপরিকল্পিতভাবে শিল্প-কারখানার তরল বর্জ্য এবং আবাসিক তরল ও কঠিন বর্জ্য ফেলার কারণে এই দূষণ হচ্ছে। কোনো কোনো নদী আজ একেবারেই দূষণের কবলে রয়েছে। এর মধ্যে গাজীপুরে টঙ্গীর পাশ দিয়ে প্রবাহিত তুরাগ নদী, শ্রীপুর উপজেলার লবলং এবং ঢাকার বুড়িগঙ্গা অন্যতম। বেশির ভাগ নদীরই সীমানা চিহ্নিত না থাকায় যে যেভাবে পারছে দখল করে নিচ্ছে। পানির অভাবে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। আর এ কারণে নদীর নাব্যতাও কমছে। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া এবং নদীর পানি কমে গিয়ে শুকিয়ে যাওয়ার কারণে মূলত দখল হয়ে যাচ্ছে নদ-নদী।

নদ-নদীর দখল, দূষণ ও নাব্যতা সংকটের ফলে নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে আর এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে হয়তো সমস্যা আরও বাড়বে। শিল্প এলাকায় নদীদূষণের কারণে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। খাল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক জলাশয়ে দূষণের কবলে থাকায় কৃষিজমিতে সেচ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

বর্তমানে আমাদের দেশের প্রায় সব নদী নাব্যতা সংকটে ভুগছে। সড়কপথের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ঘটায় মানুষ সড়কপথে যাতায়াত বেশি করে। বাংলাদেশের এখনও বহু অঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকায় যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে নৌপথ। এ ছাড়া বহু অঞ্চলে নৌপথে যাতায়ত করা যায় সারাবছর। কিন্তু সরকার সড়কপথের যোগাযোগকে প্রাধান্য দেওয়ায় এবং নৌপথ নিয়ে গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করায় দিন দিন নদীগুলো নাব্যতা হারাচ্ছে। এ ছাড়াও দেশব্যাপী ছোট ছোট নদী ও খালগুলোর দুই পাশ অবৈধ দখলদারদের দখলে থাকায় আয়তন ও গভীরতা কমে এসেছে। ফলে বর্ষাকালেও ঠিকমতো পানি হয় না অনেক নদীতে। বেদখল ও খনন না করার ফলে নদী ও খালগুলোতে নাব্যতা বজায় থাকছে না ঠিকমতো। ফলে পানি চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।

এ ক্ষেত্রে নদ-নদীর নাব্যতা নিরসনে করণীয় নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। নদীগুলো খনন করতে হবে, সাধারণ নাগরিক কিংবা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে নদীতে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে হবে। নদীর গভীরতা বাড়িয়ে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে দেশব্যাপী নদ-নদীর নাব্যতা ধরে রাখতে হবে। নদ-নদীর দূষণ কমিয়ে আনার জন্য শিল্প-কারখানার তরল বর্জ্য ও আবাসিক বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে। বেশি বেশি করে গাছ লাগাতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ নঈম আজিজ আনসারী বলেন, ‘বাংলাদেশের নদী ও জীবন একে অপরের পরিপূরক। নদীগুলো বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। আমাদের দেশের নদ-নদীগুলো দখল ও দূষণমুক্ত রাখতে সম্মিলিতভাবে কাজ করে যেতে হবে।’ নদী দখল ও দূষণমুক্ত রাখতে না পারলে, নদীর নাব্যতা ঠিক না থাকলে কৃষি ফসল উৎপাদন যেমন ব্যাহত হবে তেমনি দেশের জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক রকমের প্রভাব পড়বে। মনে রাখতে হবেÑ নদী বাঁচলে বাঁচবে দেশ।


ড. কামরুজ্জামান : শিক্ষক, কলামিস্ট ও গবেষক; সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, ভাওয়ালগড়, সদর, গাজীপুর