রাজনৈতিক দলের বিদেশ শাখার তৎপরতা

এহ্সান মাহমুদ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
রাজনৈতিক দলের বিদেশ শাখার তৎপরতা

৫ আগস্ট ২০২৪-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে বহুল আলোচিত একটি শব্দ হচ্ছে- সংস্কার। এর আগে ওয়ান ইলেভেনের সরকার যেটিকে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে অভিহিত করা হয়, সেই সময়ও সংস্কার একটা বড় ইস্যু ছিল। ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে যুক্ত করা হয়েছিল যে, দেশের কোনো দল অন্য কোনো দেশে দলের শাখা রাখতে পারবে না। এটিকে রাজনৈতিক দলের শর্ত হিসেবে বিধানে রাখা হয়েছিল। তবে আইনে বিধি-নিষেধ থাকলেও শাস্তির বিষয় রাখা হয়নি। এরপর পেরিয়েছে দেড় দশকেরও বেশি সময়।

বিদেশে কোনো রাজনৈতিক দলের শাখা থাকলে তার নিবন্ধন বাতিল হবে কিনা অথবা শাস্তি কী হবে- তা উল্লেখ করা নেই। এখন যা হচ্ছে তাতে বলা যায়- শাস্তির বিধান উল্লেখ না থাকার সুযোগটিই সম্ভবত রাজনৈতিক দলগুলো ভোগ করছে।

সম্প্রতি কিছু ঘটনায় রাজনৈতিক দলগুলোর বিদেশ শাখার ভূমিকা নিয়ে আলোচনার উপলক্ষ তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জেএফকে বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সময় জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের ওপর ডিম নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ডিম নিক্ষেপ করেছে, এমন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ইতোমধ্যে আখতার হোসেনকে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনায় এক ব্যক্তিকে নিউইয়র্ক পুলিশ আটক করেছে। আটক ব্যক্তির নাম মিজানুর রহমান চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের একজন কর্মী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আখতার হোসেনের ওপর ডিম নিক্ষেপের ঘটনায় দূতাবাসের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছে তার দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হয়ে নিউইয়র্কে গেছেন তিনটি রাজনৈতিক দলের পাঁচজন নেতা। এদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির, জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোঃ তাহের, এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন এবং এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক তাসনিম জারা।

আখতার হোসেনের ওপর ডিম নিক্ষেপের ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে দেখা যায়, বিমানবন্দর থেকে লাগেজ হাতে রাস্তা পার হচ্ছেন আখতার হোসেন। তার সামনে ছিলেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক তাসনিম জারা। সেখানে আগে থেকে জড়ো হয়ে থাকা আওয়ামী লীগের কর্মীরা আখতার হোসেনকে লক্ষ্য করে তার ওপর ডিম নিক্ষেপ করেন। ডিমটি তার পিঠে লেগে ফেটে যায়। ঘটনার সময় বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন।

এ ঘটনায় এই প্রশ্নও দেখা গিয়েছে যে, প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীদের যথাযথ নিরাপত্তার বিষয়টি কি উপেক্ষিত ছিল? ঘটনার পর আখতার হোসেনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। নিউইয়র্কে উপস্থিত এনসিপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আখতার হোসেন আওয়ামী লীগবিরোধী স্লোগান দিচ্ছেন এমন ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে। আখতার হোসেন এনসিপি কর্মীদের সঙ্গে ‘শেখ হাসিনার বিচার চাই’, ‘গণহত্যার বিচার চাই’, ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ’ স্লোগান দেন। ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোতে দেখা যায় আখতারের নেতৃত্বে এনসিপি যখন এসব স্লোগান দিচ্ছে, তখন ঠিক রাস্তার আরেক পাশে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের কর্মীরা।

এই পুরো ঘটনা একটি বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে- দেশের অভ্যন্তরে সংঘর্ষ-সহিংসতার রাজনীতির যে চর্চা অতীতে দেখা গেছে, বিদেশের মাটিতেও একইভাবে তারা করতে চাইছে। এর আগেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনে প্রবাসীদের সংঘর্ষে জড়ানোর একাধিক ঘটনা ঘটেছে। প্রশ্ন হচ্ছে- ব্যক্তিস্বার্থ এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো এসব ঘটনার দায় এড়াবে কী করে?

বিদেশে যারা এমন আচরণ করেন তারা যখন দেশের রাজনীতিতে জায়গা করে নিতে চায়, তখন অনেক সময় দেখা যায় দলীয় আনুকূল্য অর্জনের পথে এগিয়ে থাকেন। আমার মনে করতে পারি- ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের আমলে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের একজন নেতা দেশে এসে দলের মনোনয়নে সিলেটে মেয়র হয়েছিলেন। আবার অনেকের এমপি হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বিএনপি সমর্থক অনেকে দেশে এসেছেন।

অথচ দেশের বাইরে দলীয় কর্মকাণ্ড বন্ধে কোনো দলের কোনো প্রকার পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থা রাজনৈতিক দলগুলো টিকিয়ে রেখেছে কাদের স্বার্থে? যারা বিদেশ থেকে এসে নির্বাচনের জন্য মনোনীত হবেন, তাদের প্রতি স্থানীয় ভোটাররা আস্থা রাখবে কেন? সুসময়ে এসে দুঃসময়ে নিরাপদে প্রস্থান করাই তো তাদের রীতি। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে মেয়র নির্বাচিত হন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। সে সময় স্থানীয় নেতাকর্মীদের সেই ক্ষোভ-প্রতিবাদ আমলে নেয়নি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব। তবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন হলে দেশ ছেড়ে আবার লন্ডন চলে গেছেন তিনি। বিদেশে থাকা বিএনপির সমর্থকদের ক্ষেত্রেও অনেক উদাহরণ আছে। বিশেষ করে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিগত ১৭ বছর ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। সে কারণে যুক্তরাজ্যে বিএনপির সমর্থকদের তৎপরতা দেশে বাড়ছে। দলের দেশে থাকা নেতাকর্মীরা এখনই নানা অভিযোগ সামনে আনছেন।

বিদেশে রাজনৈতিক দলের শাখা চালু রাখলে কী হয় তার কয়েকটি নমুনা আমরা দেখেছি সম্প্রতি। নিউইয়র্কে বিমানবন্দরে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি থেকে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের পিঠে ডিম নিক্ষেপ করা ছাড়াও কিছুদিন আগে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর আক্রমণের চেষ্টার অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়। গত জুলাই মাসে সুইজারল্যান্ডে সফরে গিয়ে সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল হেনস্তার শিকার হন। এখন দেখা যাচ্ছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেশে নিষিদ্ধ করার পর দলটি ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে আওয়ামী লীগের ব্যানারে তৎপরতা বাড়িয়েছে। বিদেশে দলের ব্যানারে প্রতিবাদের ঘটনা নতুন নয়। আগে আওয়ামী লীগের শাসনের সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আমেরিকা, ইউরোপসহ যেখানেই সফরে গেছেন, বিএনপির সমর্থকরা তাদের দলের ব্যানারে সেই সফরের প্রতিবাদ করেছেন। তখন আওয়ামী লীগও পাল্টা স্বাগত জানানোর কর্মসূচি পালন করত। আমরা যদি আরও পিছনে ফিরে তাকাই, দেখতে পাব বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিদেশ সফরে গেলে তখন সেই দেশে আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে।

রাজনৈতিক দলের বিদেশ শাখার এ ধরনের তৎপরতা টিকিয়ে রেখে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আশা করব কী করে?

এহ্সান মাহমুদ : নির্বাহী সম্পাদক, আমাদের সময়; কথাসাহিত্যিক

মতামত লেখকের নিজস্ব