অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দিন

জোর করে চুল-দাড়ি কর্তন

সম্পাদকীয়
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দিন

আমাদের সমাজে প্রায়ই দেখা যায়, জবরদস্তি করে চুল-দাড়ি কেটে দেওয়া হচ্ছে। নারীর পোশাক নিয়ে প্রশ্ন করা হচ্ছে। নারী হেনস্তার শিকারও হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনা গত কয়েক মাস নিয়মিতভাবেই ভাইরাল হয়ে সামনে আসছে। এর আগে এসব ঘটনা ঘটলেও গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর উদ্ভূত নানা পরিস্থিতিতে এর মাত্রা যেন বেড়ে গেছে। এসব মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।

সম্প্রতি ময়মনসিংহের তারাকান্দার কোদালিয়া গ্রামে প্রকাশ্যে জোর করে বৃদ্ধ হালিম উদ্দিন আকন্দের চুল ও চুলের জট কেটে দেওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওটিতে দেখা যায়, টুপি-পাঞ্জাবি পরা তিন ব্যক্তি বাজারে বাউল ফকিরবেশী হালিমউদ্দিনের চুল কেটে দেওয়ার সময় অনেকক্ষণ চেষ্টা করেন নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। একপর্যায়ে দৌড়েও পালানোর চেষ্টা করেন তিনি। না পেরে শেষ পর্যন্ত অসহায় আত্মসমর্পণ করে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ, তুই দেহিস।’ এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে।

গত বৃহস্পতিবার আইন ও সালিশকেন্দ্র (আসক) প্রকাশ্যে জোর করে চুল কেটে দেওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ ধরনের আচরণ সম্পূর্ণ অমানবিক, বেআইনি এবং সংবিধান ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আসক বলছে, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রতিটি নাগরিককে আইনের আশ্রয়ে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার দিয়েছে। ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদ জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করেছে এবং ৩৫ নম্বর অনুচ্ছেদ কারও প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ নিষিদ্ধ করেছে। মানবাধিকার সংগঠনটি বলেছে, প্রকাশ্যে জোর করে চুল কেটে দেওয়া কেবল ভুক্তভোগীর মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতারই লঙ্ঘন নয়, বরং এটি তার মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত। এ ধরনের ঘটনা সমাজে ভীতি, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করছে। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকারের পরিপন্থী উল্লেখ করে আসকের বিবৃতিতে বলা হয়, দায়ী ব্যক্তিদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে আর কোনো নাগরিক এমন অবমাননাকর ও বেআইনি আচরণের শিকার যাতে না হন, রাষ্ট্রকে তা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু দঃখের বিষয় হলো- এই অপরাধের নিরোধকল্পে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, পত্রপত্রিকায় নানাভাবে অনেকেই এই জবরদস্তির বিরুদ্ধে বলেই চলেছেন, তবু কোনো কাজ হচ্ছে না, সরকারেরও কোনো হেলদোল নেই। ফলে এসব ঘটনার বিচার না হওয়ায় মাত্রা বেড়ে গেছে।

ভুক্তভোগীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছে। চুল বা দাড়ি জোর করে কেটে দেওয়ার ঘটনা শুধু ব্যক্তির সৌন্দর্য বা বাহ্যিক চেহারাকে আঘাত করে না; বরং এটি তার আত্মসম্মান ও বিশ্বাসকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিশেষ করে ধর্মীয় বিশ্বাস বা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ হিসেবে অনেকেই দাড়ি বা চুল লম্বা রাখেন। তাদের ক্ষেত্রে জবরদস্তি করে দাড়ি কামানো বা চুল কেটে দেওয়া মানে তার বিশ্বাসকে অপমান করা। এমন কাজ সামাজিক সহাবস্থানের জন্য ভয়াবহ হুমকি সৃষ্টি করে।

কেবল চুল-দাড়ি কাটাই নয়, চব্বিশের ৫ আগস্টের পর আমরা আরও উপদ্রব দেখেছিলাম, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা যৌনকর্মীদের পিটিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পিকনিক করতে যাওয়া নারীদের পোশাক পছন্দ না হওয়ায় তাদের মারধর করা হয়েছিল লঞ্চের ডেকে, অনেক মানুষের সামনে। নারীর সঙ্গে যৌন হেনস্তামূলক আচরণ করে ব্যক্তিকে ফুলের মালা পরিয়ে থানা থেকে বের করিয়ে নিয়ে আসার মতো নানা কাণ্ড ঘটেছে। এই সংকোচন থেকে বাঁচতে আমাদের অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে সমাজের চিন্তা, আদর্শ, পরিচয়গত বিভিন্নতার গুরুত্বগুলো অনুভব করা। মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করা। নাগরিক হিসেবে যার যার অধিকার সুরক্ষায় জোরালো আওয়াজ তোলা। নতুবা ব্যক্তির মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত আসবে আর আমরা আক্রান্ত হতেই থাকব। সেজন্য প্রতিরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে এ ধরনের আচরণের প্রতিকার করতে হবে। মানুষের ব্যক্তিত্ব ও পরিচয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সমাজ গড়তে হলে আমাদের প্রত্যেককেই সচেতন হতে হবে এবং অন্যের স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।