‘লুটপাট’ চর্চার শেকড় কোথায়
লুটপাটের চর্চা মানব ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। এটা মানুষের জিনের মধ্যে মতান্তরে মজ্জায় এমনভাবে বাসা বেঁধেছে যে, একটু সুযোগ পেলেই পোকাটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। লুটপাটের জন্য হাত-পা, আঙুল-মগজ নিশপিশ করতে থাকে। প্রিয় নবী বারবার মানা করা সত্ত্বেও লুটপাটের আদিম ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি ওহুদের যুদ্ধের অনেক যোদ্ধা। ফলে লজ্জাজনক হার হয় অবিশ্বাসীদের হাতে। তবুও কি আমরা শিক্ষা নিতে পেরেছি?
প্রবল ঝড়ে নিউইয়র্ক সিটির বিদ্যুৎ গ্রিড ভেঙে পড়েছিল ১৯৭৭ সালের ১৩ জুলাই। কোনো ব্যাকআপ কাজ করেনি ফলে পুরো শহর প্রায় ২৫ ঘণ্টা অন্ধকারে ডুবে যায়। অন্ধকার ও তীব্র গরমের সুযোগে সভ্য নিউইয়র্কবাসীরা দুষ্কৃতি বনে যায়। ব্যাপক লুটপাট চালায়। দোকানপাট ভাঙচুর, আগুন লাগানো ও গাড়ি পোড়ানোর ঘটনা ঘটে। মাত্র এক রাতেই প্রায় ১৬০০ দোকান লুট হয়। কোটি কোটি ডলারের ক্ষতি হয় শহরের অর্থনীতিতে। নিউইয়র্কের ইতিহাসে এটি অন্যতম ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও লুটপাট হিসেবে চিহ্নিত হয়।
এ বছর ফলমেলা শেষের আগেই পাইকারি হারে লুট হয়েছে প্রদর্শনীতে সাজিয়ে রাখা ফল। লুটের সাক্ষী একদল সেসবের ভিডিও ছেড়ে দিয়েছিল শৌখিন সামাজিক মাধ্যমে। তারপর সেসব ছবি ছুটে বেড়াতে থাকে দেশ আর দেশের বাইরের নানা মাধ্যমের অলিতে-গলিতে। সামাজিক মাধ্যম অসামাজিক কাজের আদান-প্রদানে বেশি আগ্রহী। শোনা যায় মেলার আয়োজকরা নাকি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মেলা শেষ হলে যার যেটা পছন্দ নিয়ে যাবেন। তাই কেউ আর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য দেরি করেনি। যে যেমন পেরেছে নিয়ে গেছে। বস্তায়-ঝোলায় ভরেছে কেউ কেউ। সামাজিক মাধ্যমে বলা হচ্ছে, হরিলুট হয়েছে ফলমেলায়। কাছাকাছি সাকিন হওয়ায় বাড়ির জানালা দিয়েই ২০২৪-এর আগস্টে তিন-চার দিন ধরে লুটপাট দেখেছি গণভবনে; লুটের মালামাল নিয়ে অনেকেই হাসিমুখে পোস্ট দিয়েছে, পোজ দিয়েছে অন্যের ক্যামেরায়।
ইতিহাস সাক্ষী নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাত ও হত্যার পর মীরজাফর তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে নবাবের হীরাঝিল প্রাসাদ লুট করে। মীরজাফরের সহযোগী রামচাঁদ সম্পর্কে বলা হয়, সে পলাশীর যুদ্ধের সময় বেতন পেত মাসিক ৬০ টাকা। এর দশ বছর পর মৃত্যুর সময় তার কাছে নগদ পাওয়া যায় ৭১ লাখ টাকা, ৪০০টি কলস ভরা স্বর্ণমুদ্রা ও রৌপ্য, ১৮ লাখ টাকার জমিদারি, বিশ লাখ টাকার জহরত। হীরাঝিল প্রাসাদ লুটের সময় মীরজাফরের সঙ্গে ছিল জগতশেঠ, রায়দুর্লভ এবং ক্লাইভ। সে সময় হীরাঝিলের প্রকাশ্য ধনভাণ্ডারে সঞ্চিত সম্পদের মধ্যে ছিল এক কোটি ৭৬ লাখ রৌপ্যমুদ্রা, ৩২ লাখ স্বর্ণমুদ্রা, দুই সিন্দুক অমুদ্রিত স্বর্ণপিণ্ড, চার বাক্স হীরা-জহরত, ২ বাক্স চুন্নি, পান্না প্রভৃতি মূল্যবান পাথর। ধনভাণ্ডারে সঞ্চিত ছিল ৮ কোটি টাকা। (সূত্র : পলাশীর যুদ্ধ পরবর্তী লুণ্ঠন’-আলফাজ আনাম মাসুম।) তবে হীরাঝিল প্রাসাদ লুটপাট হলেও তাকে ঠিক হরিলুট বলা যাবে না।
হরিলুট শব্দটির সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় রথের মেলায়। ভক্তরা মোটা দড়ি ধরে রথটা টেনে বের করার সময় চারদিকে উলুধ্বনি চলতে থাকে। ঝকঝকে পিতলের সেই রথ এখন আর নেই; একাত্তরের হানাদারদের লালসায় লুট হয়ে যায় তার পিতলের শরীর। আমরা পাড়ার কাছাকাছি বয়সের ছেলেমেয়েরা কেউ হিন্দু, কেউ খ্রিস্টান, কেউ বিহারি দল বেঁধে রথখোলায় যেতাম। আমাদের দলে ইহুদি কহেনও থাকত। আমরা সবাই দল বেঁধে দেখতে যেতাম তাজিয়া মিছিল রথের মেলা, চরক পুজো, নাম সংকীর্তন আরও কত কী!! এসব পদযাত্রায় কীভাবে একজন দলের নেতা হয়ে যেত হাঁটতে হাঁটতে। এক এক যাত্রায় এক একজন নেতার দায়িত্ব নিয়ে নিত। সেবার বাদলি ছিল আমাদের দলনেতা। সে দেখি রাস্তাঘাট ভালো চেনে। ঘুরপথ, গলিপথ সবই তার জানা। রথ তার আস্তানা থেকে রাস্তায় উঠতে বাদলি চিৎকার করে উঠল, এবার হরিলুট হবে কোঁচ পাত কোঁচ পাত- কোঁচ হচ্ছে জামার নিচের অংশ। সেটা উঁচু করে তুলে ধরলেই একটা জায়গা তৈরি হয়। মুড়ি-মুড়কি সেখানে রেখে দিব্যি খাওয়া যায়। মেয়েদের ফ্রোকের কোঁচ বড় হয়। আমাদের শার্টের ঝুল কম তাই কোঁচ হয় না তেমন। তারপরও আশায় থাকলাম দেখি রথের ওপর থেকে পুরোহিত আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা খাগড়া, বাতাসা, মুড়কি ছুড়ে দিচ্ছে। মানুষ সেগুলো কুড়িয়ে নিচ্ছে। ভেজা রাস্তায় কাদা থেকেও তুলে নিচ্ছে অনেকে। এটাও একটা বণ্টনব্যবস্থা। দিলাম আকাশে ছুড়ে ভগবান যার কপালে রেখেছে সে পাবে। ফ্রিস্টাইল বণ্টনব্যবস্থা। যার শক্তি বেশি দৌড়ঝাঁপ করতে পারে সেই বেশি পায়। খুবই বৈষম্যমূলক এই বণ্টনব্যবস্থা। অনেক দেশেই এ রকম বণ্টনব্যবস্থার ভক্ত আছে। হেলিকপ্টার থেকে দুর্গত মানুষের জন্য ত্রাণ নিক্ষেপ হরিলুট ব্যবস্থাপনার আধুনিক কার্বন কপি। টিভির সামনে বসা ক্লান্ত দর্শক দেখে রাষ্ট্রের কর্মচারীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের চলমান ছবি। সুঠাম দেহের পুরুষরাই কেবল সেসব আকাশ থেকে ফেলা ত্রাণ ধরতে পারে। বাকিরা দৌড়ায় কেবল। মারাও যায় কেউ কেউ পায়ের চাপে অথবা পড়ন্ত ত্রাণ সামগ্রীর ধাক্কায়।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
নাম সংকীর্তন হয় বা সংক্রান্তির মিছিলে দেখেছি হরি নাম গেয়ে গেয়ে সংকীর্তন শেষ পর্যায়ে কিংবা বিভিন্ন পর্যায়ে যিনি কীর্তনকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি হরিবল রবে তার সামনে একটি থালা যাতে বাতাসা, ফলমূল ইত্যাদি থাকে তাকে আকাশের দিকে ছুড়ে দেন যা যখন নিচের দিকে নেমে আসে তখন ভক্তরা হুটোপুটি করে কুড়িয়ে নেন। একে হরির লুটের প্রসাদ হিসেবে মানা হয়। ছোটবেলায় দেখেছি কার্তিক মাসে ভোরবেলা, বাড়ি বাড়ি ঘুরে নগর কীর্তন করা হতো, সেখানেও হরির লুট দেওয়া হতো। এই ছড়িয়ে দেওয়া ও লুফে নেওয়ার মাঝে সমবণ্টনের ব্যাপার নেই, যে যা পাচ্ছে, যতটুকু পাচ্ছে কুড়িয়ে নিচ্ছে। এই হচ্ছে হরির লুট। এর জন্যই বোধহয় নিয়মকানুন ছাড়া বণ্টন হরির লুটের তকমা পেয়েছে। শুধু যে নাম সংকীর্তন মিছিল বা রথযাত্রায় হরিলুট হয় তা নয়, কখনও কখনও কোনো কোনো ভক্ত ঈশ্বরের কাছে কিছু কামনা করে তার অভীষ্ট লাভের জন্য হরির লুটের মানত করে থাকেন, অর্থাৎ তার কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে, তিনি হরিনাম সংকীর্তনের আয়োজন করবেন এবং সেখানে সমাগত ভক্তদের উদ্দেশে হরিলুট দেবেন।
লুস থেকে লুট?
লুট কীভাবে যুক্ত হলো হরির (ভগবান) সঙ্গে?
পণ্ডিতরা বলছেন, কথাটি আসলে হরিলুট নয়- প্রকৃতপক্ষে শব্দটি হবে হরি লুস। শুরুর দিকে শব্দবন্ধটি ছিল ‘হরির লুস’। প্রাচীন বাংলা ভাষায় ‘লুস’ শব্দের অর্থ হলো ‘ভোজন’। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধানেও ‘লুস’ শব্দটির অর্থ দেওয়া হয়েছে ‘ভোজন’। সে হিসেবে হরির লুস শব্দটির অর্থ হলো হরির ভোজন।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
তাই যদি হবে তবে ‘লুস’ শব্দটি ‘লুট’ শব্দে পরিণত হলো কী করে বা কার আদিখ্যেতাই বা তত্ত্বাবধানে? ভাষাবিজ্ঞানের চোখে এর একটা ব্যাখ্যা আছে। ভাষা বা মনের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে মানুষের সাধারণ একটা প্রবণতা হলো কোনো অচেনা শব্দকে সে চেনা ছকে আবদ্ধ করার অবিরাম চেষ্টা করতে থাকে। ক্রমাগত চেষ্টার ফলে নতুন বা কম পরিচিত শব্দটি ধ্বনিগত সাদৃশ্য আছে এমন একটি পরিচিত শব্দের রূপ নিয়ে নেয়। কালে কালে প্রতিস্থাপিত শব্দটি আমাদের কাছে অধিক পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইংরেজিতে এই প্রক্রিয়াকে Demobilization বলে। এটার বাংলা বেশ কঠিন ‘লোকনিরুক্তি’। Demobilization-এর কব্জায় আসল নামটা হারিয়ে যায় বা বইয়ের পাতায় লেখা থাকে মাত্র। এই প্রক্রিয়ায় বিদেশ থেকে নিয়ে বিষবৃক্ষ একাশিয়াকে আমরা মনের মাধুরী মিশিয়ে ডাকি আকাশমণি বলে মিঞ্জিয়াম হয়ে যায় মনজুরি। ব্রিটিশদের ‘আর্ম চেয়ার’ হয়ে গেছে এ দেশের ‘আরাম চেয়ার’। হাতলের চেয়ারে বসে আরাম মেলে বলে আর্মের আরামে রূপান্তরিত হতে সময় লাগে না। মধ্য আমেরিকা (পানামা, কলম্বিয়াএবং ভেনিজুয়েলা) থেকে আসা ফুল পুদিকা এখন আমাদের নাগমণি। এর পাতা কারও কাছে দেখতে সাপের ফণার মতো মনে হওয়ায় এই নাম তার কপালে জুটেছে হয়তো। আনানাস হয়ে গেছে আনারস।
ঠিক একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ‘হরির লুস’ কথাটি demobilizationi মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মুখে এসে ‘হরিলুট’ হয়ে গেছে। ধারণা করা হয় মূলত হরি বা ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদিত অর্ঘ্য, বাতাসা, কদমা, নকুলদানা, মিষ্টি প্রভৃতি প্রসাদ ভক্তদের মাঝে ছুড়ে দেওয়ার সংস্কারটি এক সময় ‘হরির লুস’ নামেই প্রচলিত ছিল। কিন্তু ঘটনার অবস্থাদৃষ্টে দেখা যায়, হরিপ্রদত্ত এই প্রসাদ যাদের শক্তি বা লোকবল বেশি, তারাই কেবল সংগ্রহ করতে পারছে, বাকিরা হুড়োহুড়ি করেও কিছুই সংগ্রহ করতে পারছে না। কেবল অসহায়ের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। প্রসাদ সংগ্রহের এই ঘটনাক্রম অনেকটাই নেতিবাচক ‘লুট’ শব্দের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তাই ‘লুস’ শব্দটি demobilization প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের কাছে হয়ে যায় ‘লুট’। আর ‘হরির লুস’ হয়ে যায় ‘হরিলুট’।
বর্তমান সময়ে হরিলুট শব্দবন্ধের আক্ষরিক অর্থটি কেবল সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আচাররূপে ব্যবহৃত হলেও নেতিবাচক অর্থটিই আমাদের আচার-আচরণ-স্বভাব সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। নেতিবাচক অর্থে বলপূর্বক লুণ্ঠন বা আত্মসাৎ অর্থটির প্রয়োগই আমাদের জাতীয় জীবনে বেশি চোখ রাঙাচ্ছে। আমাদের নীতি-নৈতিকতাবোধের খুঁটি ধরে টান না মারতে পারলে আর উপযুক্ত নজরদারির কঠোর বেড়াজাল তৈরি করতে না পারলে হরিলুট নামের লুটপাটের ব্যাধি ঠেকানো যাবে না।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
গওহার নঈম ওয়ারা : লেখক ও গবেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব