মব সংস্কৃতি /
প্রতিরোধে কার্যকর দৃষ্টি দিন
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ের এক আতঙ্কজনক সামাজিক ব্যাধি হয়ে উঠেছে ‘মব সহিংসতা’ বা জনরোষ। সম্প্রতি নিউইয়র্কে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা আখতার হোসেনের ওপর হামলার পর, দেশে সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন স্থানে কিছু লোককে টার্গেট করে প্রতিশোধমূলক তৎপরতা শুরু হয়েছে। শরীয়তপুরে অভিযুক্ত ব্যক্তির বাড়িতে ডিম নিক্ষেপ কিংবা অনলাইনে হিংসাত্মক উসকানির ঘটনা রাজনৈতিক প্রতিশোধের নতুন মাত্রা নির্দেশ করে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দেওয়া পরিসংখ্যান ভয়াবহ। গত ১৩ মাসে দেশে মব সহিংসতায় নিহত হয়েছে অন্তত ২২০ জন। এ বছরের মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৬ মাসে ঘটেছে ২৩০টি হামলা, প্রাণ গেছে ৭৯ জনের, আহত হয়েছে ২৬৫ জন। এই পরিসংখ্যান শুধু একেকটি মানবিক বিপর্যয়ের গল্পই নয়, বরং একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের কাঠামোগত দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। অপরাধপ্রবণতা, সামাজিক অবিশ্বাস এবং বিচারব্যবস্থার দুর্বলতাÑ এই ত্রিমুখী সংকটে মানুষ আইনের বদলে নিজেরাই ‘বিচারক’ হয়ে উঠেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ পরিস্থিতি যদি রাষ্ট্র প্রতিকারে ব্যর্থ হয়, তবে আস্থা হারাবে জনগণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক যেমন বলছেন, রাজনৈতিক স্বার্থে মব তৈরি হচ্ছে এবং যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, তারাই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এটাই ভয়াবহ এক বার্তা, ক্ষমতাবান হলে বিচার এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। মূলত এ ধরনের বার্তা দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতিকে উৎসাহিত করে, আইনের শাসনকে দুর্বল করে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
রাজনীতিকে যদি প্রতিহিংসার হাতিয়ার বানানো হয়, আর তার বাস্তবায়ন হয় জনগণকে টার্গেট বানিয়ে, তবে তা একটি রাষ্ট্রের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। এটি কেবল ন্যায়বিচারের পরিপন্থি নয়, বরং গণতন্ত্রের মর্মমূলে আঘাত। বিচারিক প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে জনগণ যখন বিচার করতে শুরু করে, তখন সেখানে নিরপেক্ষতা বা মানবাধিকারের কোনো স্থান থাকে না।
আরও ভয়াবহ বিষয় হলো, অনেক ক্ষেত্রেই নিরপরাধ মানুষ ভুল গুজব বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারের শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। এর দায় রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। আর সামাজিক মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সহিংস আহ্বান, যেমনÑ ‘যেখানে আওয়ামী লীগ, সেখানেই মাইর’, এ ধরনের উক্তি শুধু রাজনৈতিক উগ্রতা নয়, এটি ঘৃণা ছড়ানো; যা এক প্রকার অপরাধ। এ ধরনের বক্তব্যগুলো শুধু উত্তেজনা বাড়ায় না, বাস্তব মাঠে হিংস্র প্রতিক্রিয়া তৈরির ক্ষেত্রও প্রস্তুত করে দেয়। রাজনৈতিক মতভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু ভিন্নমত দমন করার এমন পৈশাচিক প্রকাশ গণতান্ত্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। এর মানে এই নয়, ক্ষমতাচ্যুত সরকারের যেসব লোক হত্যা-খুন করেছে, দমন-পীড়ন করেছেÑ তাদের ক্ষমা করে দিতে হবে; বরং তাদের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার ও বিচার করতে হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
এখনই সময়, রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে গিয়ে সমাজকে টুকরো করে ফেলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মব সন্ত্রাস কোনোমতেই রাজনৈতিক প্রতিবাদের অংশ হতে পারে না। রাষ্ট্রকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর হতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কাজ করতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোÑ সামনে জাতীয় নির্বাচন আসছে। এই সময় রাজনৈতিক পরিবেশে স্বচ্ছতা, সহনশীলতা ও ন্যায্য প্রতিযোগিতা থাকা জরুরি। কিন্তু যদি মব জাস্টিস বা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চলতেই থাকে, তাহলে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। যদি সেই পরিবেশ না থাকে, তবে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
আরও পড়ুন:
দিকে দিকে মাফিয়াতন্ত্র-২
রাজনীতিকে মোকাবিলা করতে হবে রাজনীতির মাধ্যমেইÑ যুক্তি, মতবিনিময় ও গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে; হিংসা, ভয়ভীতি ও বিশৃঙ্খলা দিয়ে নয়। মব সন্ত্রাস বন্ধে রাজনৈতিক ঐক্য, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সামাজিক প্রতিরোধ আজ সময়ের দাবি। আমরা একটি ভয়হীন সমাজ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাইÑ এটাই আমাদের জাতীয় প্রত্যাশা।