গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি রোধে উদ্যোগ নিন

জেসমিন চৌধুরী
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি রোধে উদ্যোগ নিন

মাতৃত্ব মানবসভ্যতার পবিত্র ও দুর্লভ অভিজ্ঞতা। গর্ভধারণ কেবল একটি জৈব-প্রকৃতির প্রক্রিয়া নয়, বরং জীবনযাত্রার অব্যাহত ধারাবাহিকতার অন্যতম অনিবার্য উপাদান। কিন্তু বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশে গর্ভবতী নারীর জীবন যেন নিয়ত দুঃখ-বেদনাময় সংগ্রামের প্রতীক। বিশেষত দারিদ্র্যপীড়িত, প্রান্তিক ও সামাজিকভাবে বঞ্চিত নারীদের মাতৃত্ব একদিকে যেমন অবর্ণনীয় ত্যাগের প্রতিচ্ছবি, অন্যদিকে তেমনি তা রূপান্তরিত হয়েছে অনাবিল যন্ত্রণার প্রতীকে।

আমাদের জাতীয় বাস্তবতায় গরিব ও অসহায় গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যঝুঁকির চিত্র এক গভীর সংকটের নামান্তর। পুষ্টির মারাত্মক ঘাটতি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অপ্রাপ্যতা, চিকিৎসা সুবিধার অপ্রতুলতা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সামাজিক মানসিকতা, পারিবারিক অবহেলা এবং রাষ্ট্রীয় উদাসীনতাÑ সবকিছু মিলিত হয়ে তাদের জীবনকে মৃত্যুভয়ের শীতল অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছে। অথচ এই নারীরাই আগামী দিনের নাগরিককে পৃথিবীর আলো দেখাবেন। অর্থাৎ তাদের অনিরাপদ মাতৃত্ব মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অস্তিত্বকে বিপন্ন করা।

দারিদ্র্য নামক অদৃশ্য শৃঙ্খল তাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় যেন অমোঘ বিধিনিষেধের মতো উপস্থিত। ভোর থেকে গভীর রজনী পর্যন্ত দিনমজুরের স্ত্রী, রিকশাচালকের জীবনসঙ্গিনী কিংবা শহরের বস্তিবাসী গার্মেন্টসকর্মী নারীÑ প্রত্যেকেই সংসারের ভার বহন করতে গিয়ে গর্ভাবস্থার প্রয়োজনীয় যত্ন থেকে বঞ্চিত হন। তাদের নিত্যদিনের খাদ্যতালিকা সীমাবদ্ধ থাকে ভাত, আলু, ডাল কিংবা সামান্য শাকসবজিতে। দুধ, ডিম, মাছ কিংবা মাংস তাদের কাছে দুর্লভ স্বপ্নমাত্র। অথচ চিকিৎসাবিজ্ঞান স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছেÑ গর্ভকালে মায়ের শরীর দ্বিগুণ পুষ্টি চাহিদা অনুভব করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তারা পুষ্টির অভাবে রক্তশূন্যতায় ভোগেন এবং প্রসবকালে সামান্য রক্তক্ষরণই তাদের জীবনহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। গ্রামীণ অঞ্চলে কিংবা শহরের প্রান্তিক এলাকায় বসবাসকারী নারীরা চিকিৎসাসেবার নাগাল পান না। একজন গর্ভবতী নারীর অন্তত চারবার চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অপরিহার্য। কিন্তু অর্থাভাবে, দূরত্বের কারণে কিংবা চিকিৎসাকেন্দ্রের অপ্রতুলতার দরুন তারা তা করতে পারেন না। স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতেও চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকেন, ওষুধ থাকে না, প্রশিক্ষিত ধাত্রীও পাওয়া যায় না। ফলে তাদের নির্ভর করতে হয় অদক্ষ ধাত্রী বা কবিরাজের ওপর, যা প্রসবকালীন জটিলতার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। এখানেই শেষ নয়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিকে আরও প্রকট করে তোলে। বহু পরিবারে এখনও প্রচলিত রয়েছে, গর্ভবতী নারী বেশি খেলে সন্তান অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে যায়, ফলে প্রসবে বিপদ ঘটে। এমন অযৌক্তিক বিশ্বাসের ফলে তাদের খাদ্যগ্রহণ সীমিত করা হয়। আবার অনেক পরিবারের ধারণা, হাসপাতালে প্রসব করানো মানেই অযথা খরচ, তাই গৃহেই অদক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে প্রসব করানো হয়। এসব প্রথাগত বিশ্বাস ও কুসংস্কারের কারণে অজস্র নারী প্রতিদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন, অথচ তা প্রতিরোধযোগ্য ছিল।

বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার এখনও উদ্বেগজনক। গর্ভবতী মায়েদের শারীরিক স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিও অত্যন্ত প্রকট। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে করতে, স্বামীর অবহেলা ও পারিবারিক সহিংসতা সহ্য করতে করতে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। গর্ভকালে হরমোনের পরিবর্তনজনিত কারণে বিষণ্নতা তাদের গ্রাস করে। পরবর্তী সময়ে প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতাও তাদের মানসিক সুস্থতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অথচ মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের সমাজে সচেতনতা নেই বললেই চলে।

আজকের এই লেখার লক্ষ্য একটিইÑ গরিব ও অসহায় গর্ভবতী মায়েদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, তাদের প্রতি দায়িত্ববোধ উদ্দীপ্ত করা এবং রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া যে, গর্ভবতী নারীকে অবহেলা করা মানে জাতির ভবিষ্যৎকে অবহেলা করা। মা নিরাপদে থাকুন, শিশু সুস্থভাবে জন্ম নিকÑ তবে সত্যিকারের উন্নয়ন ও মানবিক সমাজের স্বপ্ন পূর্ণ হবে।


জেসমিন চৌধুরী : প্রাবন্ধিক