জরিপের তিতা-মিঠা জোয়ার
চলমান পরিস্থিতি ও সামনের নির্বাচন নিয়ে জরিপে বাজার সয়লাব। কদিন ধরে সমানে প্রসবের মতো অবস্থা। ডিজিটাল সুবিধা সহজলভ্য হওয়ায় সপ্তায় গড়ে দু-তিনটিও জরিপ ছাড়া হচ্ছে। এর প্রতিটিই কারও না কারও কাছে ভীষণ পছন্দের অথবা চরম অপছন্দের। যার যেভাবে সুবিধা। পছন্দওয়ালারা যার যার সুবিধামতো এসব জরিপ কোড করেন। এর আগে মাসখানেক ধরে চলেছিল ডাকসু নির্বাচন নিয়ে। এখন চলছে সামনের নির্বাচন, ভোট, পিআর পদ্ধতি, সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়তি-কমতি ইত্যাদি নিয়ে।
একের পর এক আসতে থাকা এসব জরিপের জোয়ারে নয়া তাল-ছন্দ তুলেছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইনোভেশন কনসাল্টিং। তাদের জরিপে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপির সমর্থন কমে গেছে। ৩৩ শতাংশ ভোটার পড়ে গেছে সিদ্ধান্তহীনতায়। আওয়ামী লীগের সমর্থন বেড়ে গেছে আগের চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ। ইনোভেশনের এ জরিপে প্রায় ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
ভয়েস ফর রিফর্ম ও বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক-বিআরএআইএনের সহায়তায় জরিপের ফলাফল তুলে ধরার সময় ইনোভেশনের পক্ষে জানানো হয়, সারাদেশের বিভিন্ন বয়সী ১০ হাজার ৪১৩ জন ভোটার জরিপে অংশ নিয়েছেন। ২ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাঠ জরিপটি পরিচালনা করা হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪ হাজার ৭২১ জন ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের পছন্দের দলের কথা প্রকাশ করেছেন। তাদের মধ্যে ৪১ শতাংশ বিএনপিকে, ৩০ শতাংশ জামায়াতে ইসলামীকে, প্রায় ১৯ শতাংশ আওয়ামী লীগকে, এনসিপিকে ৪ শতাংশ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশকে ৩ শতাংশ এবং জাতীয় পার্টিকে প্রায় ১ শতাংশ ভোটার ভোট দেবেন বলে জানিয়েছেন। এর আগে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক জরিপে তরুণ ভোটারদের সর্বোচ্চ রেটিং পেয়ে জনপ্রিয় নেতা হয়েছেন বলে জানিয়েছে পিপলস ইলেকশন পালস সার্ভে-পিইপিএস।
এতে জানানো হয়, জেন-জি ভোটারদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বাধিক পূর্ণ রেটিং (১০০%) পেয়েছেন। তাদের মধ্যে ২০.৮% তাকে সর্বোচ্চ রেটিং দিয়েছেন। এই প্রজন্মের ভোটারদের মধ্যে শহীদ জিয়াউর রহমান দ্বিতীয় স্থানে (১৫.৫%), খালেদা জিয়া তৃতীয় স্থানে (১০.৬%), শেখ হাসিনা (৮.৬%) এবং হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ (৪.৪%) রেটিং পেয়েছেন।
মিলেনিয়াল ভোটারদের ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান সামান্য এগিয়ে আছেন। তাদের মধ্যে ২৩.৮% তাকে পূর্ণ রেটিং দিয়েছেন, যেখানে বঙ্গবন্ধু পেয়েছেন ২২.৯%। খালেদা জিয়া পেয়েছেন ১৪.৪%, শেখ হাসিনা ৯.১% এবং এরশাদ ৫.১%। ওপরের দুই জরিপ নিয়ে নানা মহলে নানা বিশ্লেষণ। আওয়ামী লীগ ও দলটির কর্মী-সমর্থক, হিতাকাক্সক্ষীদের মাঝে বেশ পুলক।
পিআর সম্পর্কিত জরিপেরও বেশ বাজার। পরস্পর বিপরীত তথ্য এসব জরিপে। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) আরেক জরিপে বলা হয়েছে, দেশে ৭১ শতাংশ মানুষ সংসদের উচ্চকক্ষের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে (পিআর) আসন বণ্টনকে সমর্থন করেন। আরেক জরিপ বলছে, দেশের ৫৬ শতাংশ মানুষের পিআর সম্পর্কে ধারণাই নেই। এ তথ্য দেওয়া জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪ হাজার ৭২১ জন উত্তরদাতা ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের পছন্দের দলের কথা প্রকাশ করেছেন। এতে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে ৪১ দশমিক ৩০ শতাংশ উত্তরদাতার পছন্দের দল বিএনপি। জামায়াতে ইসলামীকে পছন্দ করেছেন ৩০ দশমিক ৩০ শতাংশ উত্তরদাতা। আর এনসিপি পছন্দ করেছেন ৪ দশমিক ১০ শতাংশ উত্তরদাতা। নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ উত্তরদাতার পছন্দ কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া দল আওয়ামী লীগ। চলতি বছরের মার্চের চেয়ে সেপ্টেম্বর মাসে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দিতে চাওয়া ব্যক্তিদের হার বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ।
অন্যদিকে ৪৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, বিচার হওয়ার আগে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। জরিপ অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে ভোটের দিক থেকে লাভবান হবে বিএনপি ও জামায়াত। সে ক্ষেত্রে বিএনপিকে ভোট দিতে চেয়েছেন ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ উত্তরদাতা। জামায়াতকে ভোট দিতে চেয়েছেন ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতা। আর ৮ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট দিতে না যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। দেশের ৭৮ শতাংশের বেশি মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমে সন্তুষ্টÑ এমন তথ্য দেওয়া জরিপও আছে। তথ্য, যুক্তি, হার নির্ণয় ইত্যাদিতে সবাই ভীষণ টনটনে। গবেষণা প্রক্রিয়ার (রিসার্চ মেথডোলজি) ভাষায় এই ধরনের জরিপকে বলা হয় বায়াসড বা পার্পাসিভ সার্ভে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যা আশা করেন বা যে ধরনের ফলাফল দেখতে চান, সেদিকে লক্ষ রেখে জরিপের নকশা তৈরি করা হয়। জরিপে মাঠের প্রকৃত চিত্র যেমন তুলে আনা সম্ভব। আবার নিজস্ব পছন্দ অনুসারে ফলাফলও তৈরি করা যায়। এটা নির্ভর করে গবেষণা জরিপের তথ্য-উপাত্ত ও নমুনা সংগ্রহের কাঠামো নির্ধারণের ওপর।
এসব জরিপের পেছনে কে, কারা, কোন প্রতিষ্ঠান যুক্ত তা অজানা থাকছে না। পেছনের উদ্দেশ্যও দুর্বোধ্য নয়। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে জরিপ একদম নতুন নয়। এবার ব্যাপকতা বেশি। নির্বাচনের ৫-৬ মাস আগ থেকেই তা যে পর্যায়ে চলছে, ভোট পর্যন্ত জরিপের পারদ কোথায় গিয়ে উঠবে, ভাবনার বিষয়। দেশেই নয়, বিদেশেও এ ধরনের জরিপ সাধারণত ফরমায়েশি হয়ে থাকে। কমবেশি সব দেশেই নির্বাচনের আগে নানা ধরনের জরিপ পরিচালনা করে কিছু আগাম ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক সংগঠন নিজস্ব উদ্যোগে জরিপ করে নির্বাচনী মাঠের পরিস্থিতি অনুধাবনের চেষ্টা করে। বোদ্ধারা এসব জরিপের ফলাফলের সঙ্গে নিজস্ব ধারণার সংশ্লেষ ঘটিয়ে রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন। আর রাজনৈতিক দলগুলো বা প্রার্থীরা জরিপের ফলাফল তার বা তাদের পক্ষে দেখানোর মরণপণ চেষ্টা চালান। তাই কারও তেমন আস্থা-বিশ্বাস না থাকলেও এসব জরিপ আলোচনার বেশ খোরাক দেয়। পতনের কিছুদিন আগেও শেখ হাসিনার বিষয়ে জরিপের ফলাফল ছিল মানুষ অবিরাম তাকেই চায়।
জরিপ দাঁড় করানো খুব কঠিন নয়, একদম সহজও নয়। কিছু তথ্যসাবুদ, নমুনা এবং ভাব রাখতে হয় এমন মিষ্ট বা নষ্ট কাজে। বিষয়টি দিনদুপুরে, প্রকাশ্যে, এমনকি বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানের সামনে পরিচালনা করলেও এতে মারাত্মক ইঞ্জিনিয়ারিং থাকে। কেউ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আগামী সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে আওয়ামী লীগÑ তা লাইভ দেখাতে চাইলে বর্তমান পরিস্থিতিতেও সম্ভব। বৃহত্তর ফরিদপুর বা গোপালগঞ্জ এলাকায় জরিপ চালালে ফলাফলে এমন তথ্য উঠে আসবে ঝকঝকে-তকতকে হয়ে। এরশাদকেও দেশের উন্নয়নের দাদা-বাবা হিসেবে লাইভ জরিপে প্রমাণ করা সম্ভব রংপুরসহ আশপাশের কিছু এলাকায়। উদ্দেশ্যবাদী হওয়ায় জরিপের ফলাফলকে নাকচ করে দিয়ে নির্বাচনে উল্টো ফল বেরিয়ে আসে কখনও কখনও। তার পরও অনেক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিত করতে এ ধরনের জরিপ পরিচালনা করে।
এসব জরিপকে কখনই ভুল বা ত্রুটিপূর্ণ প্রমাণ করা কঠিন। গবেষণা পরিকল্পনা, নমুনার আকার ও সংগ্রহ করার পদ্ধতি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুসরণ করেই জরিপ করা হয়েছে। কিন্তু ফলাফল এসেছে কোনো সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পক্ষে। যেমন শেখ হাসিনার শেষদিকে বিভিন্ন জরিপের ফলাফল উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, বিপুল জনসমর্থন নিয়ে তিনি আবার ক্ষমতায় আসবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের নির্বাচনে ৫ শতাংশ মানুষও ভোট প্রদান করেননি। এমনকি আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও ভোটকেন্দ্রে যাননি। কদিন ধরে জরিপের যে ট্রেন ছুটেছে এগুলো কোন মান ও পর্যায়ের তা এখনই নিরূপণ করা সমীচীন নয়। তবে এবার মাত্রার এ ভিন্নতা অনেক বার্তা দিচ্ছে। জনমতকে প্রভাবিত করা ছাড়াও এর পেছনে সম্পূরক অনেক কারণ লুকিয়ে আছে। এ অবস্থায় অনেকে গ্যালারির দর্শকের মতো আনডিসাইডেড থাকছে। আলামত দেখছে। গডগিফটেড প্রতিভা না থাকা মানুষও নমুনা দেখে কিছু বুঝে নিতে পারে। পারিপার্শ্বিকতা ও কিছু তথ্যের ভিত্তিতে ডিসিশন নেওয়ার সক্ষমতা সব মানুষেরই কমবেশি আছে। তা চা দোকানের কর্মচারী থেকে শুরু করে উবার ড্রাইভার, শতকোটি টাকার মালিক ব্যবসায়ী পর্যন্ত। তাদের বেশির ভাগই নির্বাচন চায়। কেবল নির্বাচনই নয়, নিজের ভোটটা নিজে দিতে চায়। সেই নিশ্চয়তা চায়। নির্বাচন তারা গেল তিন মেয়াদেও দেখেছে। কিন্তু ভোট দেখেনি। নির্বাচন আর ভোট, জরিপ আর বাস্তবতাÑ এসবের তফাতজ্ঞানে মানুষের অভিজ্ঞতার ঘাটতি কেটে গেছে সেই কবেই।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক-কলামিস্ট
মতামত লেখকের নিজস্ব
আরও পড়ুন:
মার্কিন শ্রমনীতি দেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য?