সরকার গঠনে সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক দলটির করণীয়
প্রায় কুড়ি বছর সরকার পরিচালনার বাইরে থাকতে বাধ্য হয়ে, ফ্যাসিবাদী ও চরম নিষ্ঠুর শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের সরকারের প্রচণ্ড হামলা-মামলা, জেল-জুলুম-গুম-খুন, গণহত্যাকাণ্ড এসব নিপীড়ন সহ্য করে টিকে থাকার মাধ্যমে সংগঠনটিকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত রেখেছে বিএনপি। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার মধ্য-ফেব্রুয়ারির আগেই নির্বাচন সম্পন্ন করবেন বলে বারবার অঙ্গীকার (প্রকাশ) করেছেন। আর সুষ্ঠু নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে বিএনপি আল্লাহর রহমতে বিজয়ী হবে সমগ্র দেশবাসী তা জানেন, আন্তরিকভাবে প্রত্যাশা করেন।
প্রায় দুই দশক ধরে ভয়ানক নিপীড়নের শিকার বিএনপির কোটি কোটি কর্মী-সংগঠক অধীর আগ্রহে সেই শুভবিজয়ের মুহূর্তটি উদযাপনের অপেক্ষায়।
এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের সামনে বিশাল এক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের ভাবনা- প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-গণমানুষের জীবনদান ও কমপক্ষে ১৩ হাজার মানুষের আহত হওয়া-পঙ্গুত্ববরণের মাধ্যমে তাড়ানো ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আওয়ামী দস্যু-রাজত্ব থেকে মুক্ত দেশবাসীকে কীভাবে প্রকৃত গণতন্ত্র ও সুশাসনের সুফল প্রত্যেকের ঘরে পৌঁছে দেওয়া যায়। প্রায় ষোলো বছর ধরে গণহত্যা, গুম-খুন, জেল-জুলুম, নানা নিপীড়ন এবং প্রায় চল্লিশ লাখ কোটি টাকার রাষ্ট্রসম্পদ লুণ্ঠনের এবং প্রায় আটাশ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের মাধ্যমে আওয়ামী-ডাকাত গোষ্ঠী রাষ্ট্রটাকে তার অর্থনীতিকে, সমাজকে সর্বস্বান্ত করে ছেড়েছে। তারা রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তছনছ করে, ধ্বংস করে দিয়েছে। এগুলোকে পর্যাপ্ত মেরামত করা, যথার্থ সংস্কারের মাধ্যমে সঠিক অবস্থানের পর্যায়ে দাঁড় করানো এক কঠিন, সুকঠিন কর্মকাণ্ডের ব্যাপার। সেটা একটা সাধারণ সরকার পরিচালনার বিষয় নয়, তার চেয়ে হাজার গুণ বড়, বিশাল কর্মকাণ্ড পরিচালনার এক অসম্ভব ধরনের তৎপরতা বাস্তবায়নের ব্যাপার।
আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলটির প্রতিটি কর্মীকে ফ্যাসিবাদী নিপীড়নের ক্ষত সহ্য করে আবার জেগে উঠতে হবে নতুন উদ্যমে, প্রবল দেশপ্রেমে, অসীম কর্মদক্ষতা নিয়ে। রাষ্ট্রের নেতিবাচক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলা মোটামুটি সহজ কাজ, কিন্তু তার বিপরীতে ততোধিক ইতিবাচক উন্নয়নকর্ম সাধন করে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিক জায়গায় দাঁড় করানো হাজার গুণ কঠিন কাজ।
বিএনপি সংগঠক-নেতাকর্মীদের হাতে অনেক কাজ- তাদের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিকভাবে চালাতে কাজ করতে হবে, তাদের পাহারা দিতে হবে- ফ্যাসিবাদী আওয়ামী দুর্বৃত্তগোষ্ঠীর পোষা-আমলাদের শয়তানির খোঁজখবর রাখতে হবে, প্রতিটি পাড়ায়-মহল্লায় আওয়ামী দুর্বৃত্তচক্রের সব ষড়যন্ত্র তৎপরতা দ্রুততার সঙ্গে ধরে ফেলে তার প্রতিকার, প্রতিরোধ করতে হবে। ফ্যাসিবাদীদের একটি খুদে সদস্যও যেন বিএনপি বা অন্য কোনো গণতন্ত্রপ্রেমী রাজনৈতিক দলে ঢুকে যেতে না পারে সেদিকে সর্বক্ষণ নজরদারি, কঠিন-কঠোর নজরদারি চালাতে হবে।
স্মরণ রাখা দরকার, এ দেশে ১৯৭২-১৯৭৫ আগস্ট অবধি কুড়ি হাজার থেকে তেত্রিশ হাজার (সংখ্যাটি নিয়ে কিছুটা মতানৈক্য আছে) প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী ও বিভিন্ন পেশার ভালো কর্মী খুন হয়েছে আওয়ামী দুর্বৃত্ত ও তাদের রক্ষীবাহিনীর হাতে, তারা রাষ্ট্রসম্পদ লুণ্ঠন করেছেন অবাধে, লাখো মানুষকে দুর্ভিক্ষে মেরেছেন নিজেদের দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অদক্ষতার কারণে। পরবর্তীকালে তাদের বিচার করাটা ছিল সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় কাজ, কিন্তু নানা কারণে পরে আর সেসব গুরুতর অপরাধের বিচার করা যায়নি, সেসব অপরাধী অনাচারের দানব হয়েছে পরবর্তীকালে।
স্বৈরাচার এরশাদ আমলে নয় বছরে অসংখ্য গুম-খুন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এবং প্রায় ছয় লাখ কোটি টাকার (তখনকার অন্তত নব্বই হাজার কোটি টাকা- এখনকার মুদ্রামানে প্রায় ছয় লাখ কোটি টাকা) রাষ্ট্রসম্পদ লুট করেছে এরশাদ ও তার চেলাচামুণ্ডারা। এরশাদের চামচারা সেই টাকা দিয়ে রাজনীতি করে, ভোগবিলাসের মত্ততায় মাতে, তাদের নৃশংস সব অপরাধের কোনো বিচার করা যায়নি। এসব মাফিয়া দুর্বৃত্তের বিচার করা উচিত ছিল প্রথম সুযোগেই; না, তা করার কারও ইচ্ছাই ছিল না। এসব খুনি-দস্যু-ডাকাতদের বিচার করা যায়নি তাই শেখ হাসিনা আর তার আওয়ামী দস্যুগোষ্ঠী এমন অপরাধী হতে সাহসী হয়েছে। রাষ্ট্রপতি জিয়া, মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল মনজুরকে হত্যা করেছে তখনকার সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, অন্য অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে ‘কোর্ট মাশালের’ নামে ফাঁসি দিয়েছে এরশাদ, সামরিক বাহিনী থেকে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বিতাড়িত করেছে, অনেককে অন্যায়ভাবে জেল দিয়েছে, রাষ্ট্রসম্পদ লুট করে অবাধে বিদেশে পাচার করেছে। রাজপথে নয় বছরের আমলে যেসব প্রতিবাদী এরশাদবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীকে গুলি করে ও অন্যভাবে হত্যা করেছে তার সংখ্যাও কিন্তু তিনশর নিচে নয়। চট্টগ্রামে একদিনে কয়েক ঘণ্টায় ২৪ জন রাজপথের কর্মীকে চরম নিষ্ঠুরতায় হত্যা করে এরশাদের বর্বর বাহিনী। কিন্তু এরশাদের বিচার করা যায়নি। বিশ^সেরা ইবলিস-স্বৈরাচার এরশাদের এবং তার বদমায়েশগোষ্ঠীর হাজার হাজার অপরাধীর কোনো বিচার হয়নি, শাস্তি হয়নি, তাদের বরং ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ব্যবহার করে তার শয়তানির মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়েছেন।
এখন প্রতিটি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ-দস্যুর বিচার করা সবচেয়ে জরুরি, আমরা চাই যথার্থ সুবিচার- যারা প্রকৃত দোষী, ফ্যাসিবাদের জন্য আসল দায়ী তাদের সুষ্ঠু বিচার। তা না করা হলে দেড়-দুই হাজার (সংখ্যাটি নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে) শহীদের পিতামাতা-ভাইবোন-স্বজন এবং প্রায় ১৩ হাজার গুলিবিদ্ধ-আহত ও পঙ্গু ব্যক্তিরা এবং তাদের স্বজনরা বিচার না পাওয়ার শোকে আমাদের অভিশাপ দেবে- সেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আর নীতিগত প্রশ্নে এসব গণহত্যা ও পঙ্গু বানানো মানুষ, গুম-খুনের শিকার লোকজন ও তাদের স্বজনদের কাছে আমাদের দায়বদ্ধতার কী জবাব দেব আমরা!
আমাদের বিএনপি নেতাকর্মীদের আশু করণীয় : ১. প্রতিটি গ্রামে, পাড়ায়-মহল্লায় ফ্যাসিবাদী আওয়ামী দুর্বৃত্তদের ষোলো বছরের সব অপরাধের, সব অনাচারের প্রকৃত ঘটনাবলি ইতিহাস-আকারে লিপিবদ্ধ করার লক্ষ্যে বিএনপির স্থানীয় নেতাদের নেতৃত্বে ১১ জনের একেকটি কমিটি গঠন ও তদন্তকাজ শুরু করা। ২. আওয়ামী ডাকাত-দস্যুরা যত রাষ্ট্রসম্পদ, সংখ্যালঘু সম্পদ অর্থকড়ি দখলে নিয়েছে তার প্রকৃত চিত্র লিপিবদ্ধ করতে হবে। এবং সেসব পুনরুদ্ধারে উদ্যোগ নিতে হবে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের প্রতিটি কর্মীকে যাতে বিচারের আওতায় আনা যায় তার ব্যবস্থায় পাহারা বসাতে হবে। ৩. প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের আশ্রয়স্থলের অবস্থান থেকে কোনো আওয়ামী লীগার যেন দেশে পালিয়ে এসে তৎপরতা চালানোর সুযোগ না পায় তার জন্য ২৪ ঘণ্টার নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. ফ্যাসিবাদী আওয়ামী দস্যুরা বিএনপি কর্মীদের একটা দুর্বলচেতা অংশকে অর্থকড়ি ঘুষ দিয়ে বিএনপির মধ্যে অবস্থান নেওয়া বা পালিয়ে গ্রাম-মহল্লায় তৎপরতা চালানোর অপচেষ্টা চালাবে (এখনো চালাচ্ছে), তা প্রতিরোধে সজাগ থাকতে হবে। ৫. আমলাতন্ত্রের ভেতরে আওয়ামী দুর্বৃত্ত আছে লাখ লাখ, তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সদাজাগ্রত থাকতে হবে। ৬. গ্রাম-পাড়া-মহল্লায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার লক্ষ্যে কোনো ‘মেগা প্রকল্পের অপচয়’ বাদ দিয়ে প্রকৃত উন্নয়ন কাজে মনোযোগী হতে হবে। ৭. শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্বেচ্ছাশ্রমে খাল কাটা ও গ্রামীণ সমবায়ের মাধ্যমে উৎপাদন কর্মকাণ্ড অবিলম্বে চালু করতে হবে। ৮. বনভূমি ও পাহাড় ধ্বংস করা ঠেকিয়ে পরিবেশবিধ্বংসী সব কাজ থেকে সবাইকে বিরত রাখার বিশেষ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ৯. ঘুষ ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সবাইকে নিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। ১০. কোনো এলাকায় ফসলহানি বা আর্থিক সংকট, পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটলে তার প্রতিকারে ব্যবস্থা, যেমন লঙ্গরখানা খোলাসহ নানান উদ্যোগ চালু করতে হবে। ১১. ধর্মীয় সম্প্রীতি অটুট রাখা, আসল অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ বজায় রাখতে সদাজাগ্রত থাকতে হবে। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান আমরা সবাই একে অপরের ভাই ও বোন, প্রত্যেকে এই রাষ্ট্রের সমানাধিকার পাওয়া নাগরিক- এটা মাথায় রাখতে হবে।
আমরা যদি এসব কর্মতৎপরতা চালাতে পারি, তাহলে আমাদের জনগণের ভোটের জন্য ‘ভিক্ষুক’ হতে হবে না, আপনাআপনি ভোট চলে আসবে, ইনশা আল্লাহ।
খায়রুল কবীর খোকন : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক ডাকসু সাধারণ সম্পাদক
মতামত লেখকের নিজস্ব
আরও পড়ুন:
মার্কিন শ্রমনীতি দেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য?