শিশুশ্রম চাই না, পড়তে চাই
আমরা শিশুশ্রম চাই না, পড়তে চাই। মানুষের জীবনে সবচেয়ে আনন্দের সময় হলো শৈশব। এই সময়টা খেলাধুলা, হাসি, গান, কবিতা, গল্প আর বইয়ের সঙ্গে কাটানোর কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো আমাদের সমাজে হাজার হাজার শিশু আছে যারা বই হাতে নিতে পারে না। তাদের কাঁধে থাকে ভারী বোঝা, হাতে থাকে কাজের সরঞ্জাম, চোখে থাকে অবসাদের ছাপ। স্কুলে যাওয়ার বদলে তারা কাজ করতে যায়। কেউ হোটেলে থালা ধোয়, কেউ রাস্তায় বাদাম বিক্রি করে, কেউ ইটভাটায় কাজ করে, কেউ বাসাবাড়িতে ঝাড়– দেয়। অথচ এই বয়সে তাদের বই পড়া, খেলা আর স্বপ্ন দেখার কথা ছিল। তাই আমরা বলতে চাই- শিশুশ্রম চাই না, পড়তে চাই।
একদিন সকালে আমি রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম এক ছোট্ট ছেলে রোদে দাঁড়িয়ে কলা বিক্রি করছে। বয়স হবে নয়-দশ বছর। ময়লা জামা, কপালে ঘাম, আর মুখে ক্লান্তির ছাপ। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি স্কুলে যাও না? ছেলেটি লজ্জা পেয়ে বলল, না ভাইয়া, স্কুলে যাওয়ার সুযোগ নেই, বাবা অসুস্থ, মা কাজ করে, তাই আমাকেই সংসার চালাতে হয়। তার চোখে আমি অদ্ভুত এক দুঃখ দেখলাম। সে যদি স্কুলে যেত, হয়তো আজ কবিতা মুখস্থ করত, হয়তো বন্ধুর সঙ্গে খেলত, কিন্তু তার শৈশব হারিয়ে গেছে। এ দৃশ্য দেখে আমি গভীরভাবে বুঝলাম, শিশুশ্রম কেবল একটি শিশুর নয়, পুরো জাতির জন্য এক অভিশাপ।
শিশুশ্রম কেন হয়? এর প্রধান কারণ দারিদ্র?্য। গরিব পরিবারে বাবা-মা যখন নিজেরাই সংসার চালাতে পারে না, তখন তারা সন্তানের হাতে বই না দিয়ে কাজে পাঠায়। কেউ ভাবেন, এখন যদি কাজ করে টাকা আনে, তাহলে অন্তত খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। কিন্তু এতে তারা ভুল করে, কারণ পড়াশোনা না করলে সেই শিশু সারাজীবন দারিদ্র্য?ের শৃঙ্খলেই আটকে থাকবে। আরেকটি কারণ হলো অশিক্ষা। বাবা-মা যদি নিজেরাই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, তারা বোঝে না যে শিক্ষা ছাড়া জীবনে উন্নতি সম্ভব নয়। তাই তারা ভাবে- কাজ করলেই টাকা আসবে, পড়াশোনায় সময় নষ্ট কেন! এর ফল হলো- প্রতিদিন হাজার হাজার শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়। কিছু মালিকও দোষী। তারা জানে শিশুদের দিয়ে কাজ করালে কম টাকায় কাজ করানো যায়। তাই তারা শিশুশ্রমিক খোঁজে। এভাবে শিশুশ্রম চলতে থাকে। অথচ আমাদের আইন আছে, শিশুদের দিয়ে কঠিন কাজ করানো নিষিদ্ধ। কিন্তু আইন মানা হয় না, নজরদারি কম। ফলে শিশুদের শৈশব কেড়ে নেওয়া হয়।
শিশুশ্রমের ক্ষতি অনেক। প্রথমত, শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না, তাই তারা অশিক্ষিত থেকে যায়। দ্বিতীয়ত, তাদের কোমল শরীর কষ্টে ভেঙে পড়ে। ভারী ইট বহন করতে গিয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে যায়, হোটেলে ধোঁয়ার মধ্যে কাজ করতে গিয়ে ফুসফুস নষ্ট হয়। তৃতীয়ত, তাদের মানসিক অবস্থাও খারাপ হয়। খেলা না করতে পারায় তারা দুঃখী হয়ে যায়, আত্মবিশ্বাস হারায়। চতুর্থত, সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো- তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায়।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
একটি দেশের উন্নতির জন্য শিক্ষিত নাগরিক দরকার। যদি শিশুরা পড়াশোনা না করে, তাহলে সেই দেশ কখনও উন্নত হতে পারবে না। তাই শিশুশ্রম একটি দেশের জন্যও বড় ক্ষতি।
আমরা চাই পড়াশোনা করতে। আমরা চাই স্কুলে যেতে। আমরা চাই হাতে কলম ধরতে, বই পড়তে, পরীক্ষায় অংশ নিতে। আমরা চাই বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে, গান গাইতে, কবিতা পড়তে। শৈশবের আনন্দ যেন কাজে নষ্ট না হয়। প্রতিটি শিশু যেন বলার সুযোগ পায়- আমরা শিশুশ্রম চাই না, পড়তে চাই।
এজন্য সরকারের বড় দায়িত্ব আছে। দরিদ্র পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে, যাতে তারা সন্তানের পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারে। স্কুলে বিনামূল্যে শিক্ষা দিতে হবে, দুপুরে খাবার দিতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধের আইন কঠোরভাবে কার্যকর করতে হবে। যে কোনো কারখানা, হোটেল বা বাড়িতে শিশুশ্রম পাওয়া গেলে কঠিন শাস্তি দিতে হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
কিন্তু শুধু সরকার নয়, আমাদের সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে, আমরা কোনো শিশুকে শ্রমিক হিসেবে কাজে নেব না। যদি দেখি কেউ শিশুশ্রম করাচ্ছে, আমরা প্রতিবাদ করব। ধনী পরিবারগুলো গরিব শিশুদের পড়াশোনার খরচ বহন করতে পারে। শিক্ষকরা চেষ্টা করবেন, যাতে সব শিশু স্কুলে আসে। আর আমরা যারা ছাত্র, তারাও আমাদের বন্ধুকে স্কুলে টানব, যদি সে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়।
আসুন আমরা সবাই মিলে বলি- আমরা শিশুশ্রম চাই না, পড়তে চাই। আমরা চাই প্রতিটি শিশু যেন শ্রেণিকক্ষে বসে শিক্ষক-শিক্ষিকার কথা শোনে, পরীক্ষায় অংশ নেয়, বড় হয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করে। আমরা চাই না কোনো শিশুর চোখের স্বপ্ন নিভে যাক। শিশুরাই আগামী দিনের নেতা, কবি, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, ডাক্তার। তাদের হাতে কাজের বোঝা নয়, স্বপ্নের বই তুলে দিই।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
জান্নাতি আক্তার : শিক্ষার্থী, জুমারবাড়ী দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়, সাঘাটা, গাইবান্ধা