এগিয়ে একুশে বইমেলা : অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত
অমর একুশে বইমেলা কেবল একটি মেলা নয়- এটি আমাদের জাতিসত্তার প্রতীক, ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় স্মৃতি এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। ফেব্রুয়ারি মাস এলে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ভরে ওঠে লেখক-পাঠক-প্রকাশকের মিলনমেলায়। একুশের শহীদদের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই আয়োজন তাই আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কিন্তু সম্প্রতি ২০২৬ সালের বইমেলা দেড় মাস এগিয়ে ১৭ ডিসেম্বর থেকে (১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত) শুরু করার ঘোষণা এসেছে। এই সিদ্ধান্ত লেখক, প্রকাশক ও পাঠকমহলে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। কারণ এটি নিছক একটি তারিখ পরিবর্তন নয়; বরং দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ভেঙে দেওয়ার মতো অযৌক্তিক উদ্যোগ। একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে যে অনন্য মর্যাদা পেয়েছে, ডিসেম্বরের আয়োজন সেই মর্যাদাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
অমর একুশে বইমেলার সূচনা ১৯৭২ সালে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সৃজনশীল প্রকাশনার পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব চিত্তরঞ্জন সাহার ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে কয়েকটি বইয়ের স্টল বসানো দিয়ে। পরে ধীরে ধীরে এর বিস্তার ঘটে। ১৯৮৪ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে স্বীকৃতি পায় এবং বাংলা একাডেমি এর আয়োজক হয়। সেই থেকে ফেব্রুয়ারি মানেই বইমেলা, একুশের শহীদদের স্মরণে সাহিত্য-সংস্কৃতির উৎসব। ফেব্রুয়ারি শুধু একটি মাস নয়, বরং আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রতীক। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া, ভাষাশহীদদের স্মরণ- সবই ফেব্রুয়ারির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এই আবহেই বইমেলা প্রাণ পায়। ডিসেম্বর মাসে মেলা আয়োজন করলে সেই সাংস্কৃতিক- ঐতিহাসিক সংযোগ সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যাবে।
আমরা পছন্দ করি বা না করি, এটাই বাস্তবতা যে প্রতিবছর লেখকরা ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসজুড়ে তাদের নতুন বইয়ের পা-ুলিপি প্রকাশকের কাছে হস্তান্তর করেন। অনেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত লেখালেখি, সম্পাদনা, প্রুফ সংশোধনের কাজ চালান। হঠাৎ যদি ডিসেম্বরেই মেলা শুরু হয়, তাহলে অধিকাংশ বই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
যারা কোনোভাবে দ্রুত বই শেষ করবেন, তাদের পা-ুলিপি যাবে তাড়াহুড়ো করে প্রকাশকের কাছে। প্রুফরিডিং, কভার ডিজাইন, সম্পাদনা- সবকিছু হবে অগোছালো। অথচ একটি বই কেবল লেখকের কলমে নয়, বরং প্রুফ সংশোধন, শৈল্পিক মুদ্রণ, নান্দনিক প্রচ্ছদ- সবকিছুর সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়া সংকুচিত হলে সৃজনশীলতার মান ক্ষুণœ হওয়া অনিবার্য।
প্রবাসী অনেক লেখক ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা চলাকালে দেশে আসবেন, এই পরিকল্পনায় আগেভাগে উড়োজাহাজের টিকেট বুকিং দিয়ে রাখেন। বইমেলার সময়সীমা দেড় মাস এগিয়ে এলে তারাও বিড়ম্বনায় পড়বেন।
বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্প দেশের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অথচ প্রাণবন্ত খাত। বার্ষিক আয়-ব্যয়ের বড় অংশই আসে বইমেলা ঘিরে। অনেক ক্ষুদ্র প্রকাশক সারাবছরের বিক্রির প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ অর্জন করেন এই এক মাসে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
মেলা দেড় মাস এগিয়ে নিলে প্রকাশকরা পড়বেন চরম সংকটে। সীমিত সময়ে বিপুল পরিমাণ বই ছাপাতে গিয়ে ছাপাখানায় ভিড় তৈরি হবে, মুদ্রণ-ভুল বাড়বে, নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করতে হবে। প্রচার-প্রচারণার জন্যও যথেষ্ট সময় থাকবে না। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বিশেষত ক্ষুদ্র প্রকাশকরা, যাদের টিকে থাকার একমাত্র ভরসা বইমেলা।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও বিষয়টি গুরুতর। প্রতিবছর বইমেলা ঘিরে প্রায় হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। লেখক-প্রকাশকের পাশাপাশি হাজারো প্রুফরিডার, বাঁধাই শ্রমিক, বিক্রেতা, কভার ডিজাইনার, গ্রাফিকস শিল্পী এই সময়ে কাজ পান। সময় এগিয়ে দিলে এসব অর্থনৈতিক চক্র ভেঙে পড়বে, কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমাদের সৃজনশীল বই প্রকাশনা বইমেলাকেন্দ্রিক হওয়ার আরও কিছু কারণ রয়েছে। (কোনো কোনো প্রকাশক বছরব্যাপী বই প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু এই সংখ্যা হাতে গোনা।) সার্বিকভাবে বইয়ের বাজার সীমিত হওয়ায় অধিকাংশ সৃজনশীল প্রকাশক বইমেলাকেন্দ্রিক প্রকাশনায় অভ্যস্ত। বইমেলার কাছাকাছি সময় বই প্রকাশ করলে প্রকাশকদের পুঁজি কম সময়ের জন্য আটকে থাকে। এ ছাড়াও প্রবাসী লেখক এবং স্ব-অর্থায়নে প্রকাশকদের মাধ্যমে বই প্রকাশকারী লেখকরাও বছরের যেকোনো সময় নয়, শুধু বইমেলায় বই প্রকাশে আগ্রহী। কেননা এ সময় মিডিয়ায় বই নিয়ে প্রচার-প্রচারণা সহজ ও সাশ্রয়ী হয়। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে পাঠকের। তারা বইমেলায় আসে নতুন বই কিনতে, লেখকদের সঙ্গে দেখা করতে, সাংস্কৃতিক আসরে অংশ নিতে, উৎসবমুখর পরিবেশ উপভোগ করতে। কিন্তু তাড়াহুড়া করে ছাপানো বই মানহীন হলে- বানান ভুল, অস্পষ্ট ছাপা, খারাপ বাঁধাই, অনুজ্জ্বল প্রচ্ছদ- তাহলে পাঠকের আগ্রহ কমে যাবে।
একটি বইমেলার প্রাণশক্তি নিহিত থাকে পাঠকের উৎসাহে। পাঠক যদি হতাশ হয়, তাহলে পুরো আয়োজনের মর্যাদা ক্ষুণœ হবে। বইমেলার প্রতি আস্থা হারালে দীর্ঘ মেয়াদে পাঠাভ্যাসও ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা আমাদের পাঠ সংস্কৃতির জন্য ভয়াবহ সংকেত। বইমেলা শুধু কেনাবেচার জায়গা নয়; এটি তরুণ প্রজন্মকে সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট করে, পাঠাভ্যাস গড়ে তোলে, জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তোলে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা বইমেলায় এসে লেখকদের লেখা নতুন বই খুঁজে পান, আবৃত্তি-আলোচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। শহীদ দিবসের আবেগ বইমেলাকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে।
ডিসেম্বরে এই আবহ তৈরি হবে না। একুশের শহীদদের স্মরণ, ভাষার মর্যাদা রক্ষার চেতনা- সবই ফেব্রুয়ারির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই বইমেলাকে ডিসেম্বর মাসে সরিয়ে নেওয়া তরুণ প্রজন্মকে সাংস্কৃতিক শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করার ঝুঁঁকি ডেকে আনবে।
বিশ্বজুড়ে বড় বড় বইমেলা, যেমন- ফ্রাংকফুর্ট, লন্ডন বা কলকাতা- সবগুলোরই নির্দিষ্ট সময় ও প্রেক্ষাপট রয়েছে। সেখানে সময় পরিবর্তনের কোনো দৃষ্টান্ত নেই। বাংলাদেশের একুশে বইমেলা অনন্য, কারণ এটি ভাষা আন্দোলনের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের বইমেলার মর্যাদা এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই। যদি ডিসেম্বর মাসে মেলা আয়োজন করা হয়, তবে এই অনন্য মর্যাদা হারিয়ে যাবে। আন্তর্জাতিকভাবে এটি আর ‘একুশে বইমেলা’ হিসেবে পরিচিত হবে না; কেবল একটি সাধারণ বইমেলা হয়ে দাঁড়াবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
তাহলে প্রশ্ন জাগে- কোন যুক্তিতে বইমেলার সময় এগিয়ে আনা হলো? লেখক, প্রকাশক, পাঠক- কোনো পক্ষই এর সুফল পাবে না। সাংস্কৃতিক অঙ্গনও এতে লাভবান হবে না। বরং সৃজনশীলতার মান ক্ষুণœ হবে, অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে, পাঠক হারাবে আগ্রহ। নির্বাচন ও রোজার অজুহাতে একুশে বইমেলা এগিয়ে আনা অযৌক্তিক। ১৯৭৯, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে সাধারণ নির্বাচন যথাক্রমে ১৮, ২৭ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হলেও বইমেলা যথারীতি ফেব্রুয়ারি মাসে হয়েছে।
আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করতে চাই, রোজার মাসেই মাসব্যাপী বায়তুল মোকাররমে ইসলামি বইয়ের জমজমাট মেলা হয়ে থাকে। এই মেলা শুধু বই কেনাবেচার ক্ষেত্র নয়, বরং মুক্তচিন্তা, নতুন ধারার সাহিত্য, মতবিনিময় ও সাংস্কৃতিক চর্চার উৎসব। তরুণ প্রজন্ম এখানে খুঁজে পায় প্রেরণা, বাঙালির সাংস্কৃতিক শক্তি এখানে সঞ্চারিত হয়। তাই এর সময় এগিয়ে আনা মানে ঐতিহ্যের অবমূল্যায়ন।
অযৌক্তিক তারিখ পরিবর্তনের পরিবর্তে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। নির্বাচন ও রোজার কারণে বইমেলার সময়সূচি যদি কিছুটা এগিয়ে আনতেই হয়, তাহলে ৮ জানুয়ারি থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত করা হলে একদিকে মেলার সময় কিছুটা বাড়ানো সম্ভব, অন্যদিকে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে সাংস্কৃতিক সংযোগও বজায় থাকবে।
এই সময়সূচি লেখক-প্রকাশককে পর্যাপ্ত প্রস্তুতির সুযোগ দেবে, মানসম্পন্ন বই প্রকাশ হবে, পাঠকও পাবে প্রাণবন্ত উৎসবের স্বাদ। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘একুশে বইমেলা’ নামের মর্যাদাও অক্ষুণœ থাকবে।
অমর একুশে বইমেলা আমাদের জাতির ইতিহাস ও চেতনার ধারক। এটি লেখক-পাঠক-প্রকাশকের মিলনমেলা, মুক্তচিন্তা ও সাংস্কৃতিক চর্চার উৎসব। দেড় মাস এগিয়ে বইমেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিছক ক্যালেন্ডারের পরিবর্তন নয়; এটি আমাদের ঐতিহ্য ও গৌরবের ওপর অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ।
লেখক- প্রকাশকদের দাবি স্পষ্ট- পরিকল্পিত প্রস্তুতির মাধ্যমে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে মেলা আয়োজন করা হোক। তবেই আমরা ভাষাশহীদদের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জানাতে পারব এবং একুশের চেতনায় সমুজ্জ্বল রাখব অমর একুশে বইমেলাকে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
সাঈদ বারী : লেখক, প্রকাশক
মতামত লেখকের নিজস্ব