মানবাধিকারের সমাধিস্থল ফিলিস্তিনের গাজা
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা আজ পৃথিবীর অন্যতম ভয়াবহ মানবাধিকার সংকটের প্রতীক। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক যুদ্ধ, সংঘাত ও হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে, কিন্তু গাজার মাটিতে যা ঘটছে তা মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় লজ্জা। প্রতিদিন শিশুদের লাশ, নারীদের কান্না এবং ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে ভেসে আসা আর্তনাদ যেন আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেÑ মানবাধিকার শব্দটি আজ এখানে কবর দেওয়া হয়েছে। গাজা আজ কেবল একটি ভৌগোলিক অঞ্চল নয়; এটি মানবতার ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
গাজার এই দুঃসহ পরিস্থিতি হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনি জনগণ দখল, অবরোধ ও নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে। ১৯৪৮ সালের নাকবা (যে সময় লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি তাদের জন্মভূমি থেকে উৎখাত হয়েছিল) থেকে শুরু করে ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে দখলকৃত ভূমি পর্যন্ত প্রতিটি অধ্যায়ই নিপীড়নের সাক্ষ্য বহন করছে। নাকবার পর প্রায় সাত লাখ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। তাদের উত্তরসূরিরা আজও শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। গাজা বর্তমানে মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারের এক ছোট্ট ভূখণ্ড, যেখানে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ গাদাগাদি করে বসবাস করছে। চারদিকে ইসরায়েলের দেয়াল, সীমান্ত চেকপোস্ট, সমুদ্রপথে অবরোধÑ মানুষগুলো যেন খাঁচার ভেতরে বন্দি পাখির মতো বেঁচে আছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা এই ভূখণ্ডকে বহুবার ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় ওপেন এয়ার প্রিজন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধের সময় বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। জেনেভা কনভেনশন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন স্পষ্ট করে বলেছেÑ হাসপাতাল, স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র কিংবা মানবিক সহায়তার কাফেলাগুলো কখনোই হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারবে না। কিন্তু গাজার বাস্তবতায় এই আইনগুলো নিছক কাগুজে দলিল। ইসরায়েলি সেনারা হাসপাতাল গুঁড়িয়ে দিয়েছে, জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলে বোমা বর্ষণ করেছে, এমনকি আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের গাড়িও রেহাই পায়নি। শিশুরা, গর্ভবতী নারী, বয়স্ক কিংবা রোগীÑ কারও প্রতি দয়া দেখানো হয়নি। আত্মরক্ষার নামে তারা যে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে তা আসলে আন্তর্জাতিক আইনের নগ্ন অবজ্ঞা।
আরও ভয়াবহ হলো, জীবনধারণের মৌলিক উপকরণগুলোও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ, পানি ও খাদ্যের সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একটি গোটা জনগোষ্ঠীকে উপবাস ও তৃষ্ণার মধ্যে ফেলে দেওয়া গণশাস্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ। কিন্তু গাজায় প্রতিদিন মানুষ পানি খুঁজে হাহাকার করছে, হাসপাতালে ওষুধ নেই, বিদ্যুৎ না থাকায় অপারেশন থেমে যাচ্ছে, শিশুরা খাবারের অভাবে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, প্রতিদিন প্রায় অর্ধেক হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়ছে। কারণ জ্বালানি নেই, ওষুধ নেই, ডাক্তাররা কাজ করতে পারছেন না। সাম্প্রতিক সংঘাতে ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং ১ লাখ ৬৬ হাজারের বেশি আহত হয়েছে। মৃতদের বড় অংশই শিশু ও নারী। প্রতিদিন মৃতদেহের সারি দীর্ঘ হচ্ছে, অথচ বিশ্বনেতারা নীরব দর্শক।
গাজার শিশুদের পরিস্থিতি সবচেয়ে করুণ। বিভিন্ন রিপোর্ট বলছে, গাজার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই শিশু। তারা খেলনা নয়, দেখে ধ্বংসস্তূপ; তারা স্কুলে যায় না, আশ্রয়কেন্দ্রে লুকিয়ে থাকে। অনেক শিশু বাবা-মাকে হারিয়েছে, আবার অনেকে হাত-পা হারিয়ে সারাজীবনের জন্য অক্ষম হয়ে পড়েছে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, গাজার প্রতিটি শিশুই মানসিক ট্রমায় ভুগছে। যুদ্ধবিরতির ক্ষণিকের সুযোগ পেলেও তারা আতঙ্ক ভুলতে পারে না, কারণ আকাশে ড্রোনের গুনগুন শব্দ তাদের আবারও বোমার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন:
সব প্রতীক্ষার সমাধান হবে?
শিক্ষাব্যবস্থাও প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলগুলোতে আশ্রয় নেওয়া হাজারো পরিবার এখন গৃহহীনতার শিকার। পাঠদান বন্ধ, বই নেই, শ্রেণিকক্ষ ভেঙে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। একটি গোটা প্রজন্ম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢাকা পড়ছে। যুদ্ধ কেবল ভবন ধ্বংস করছে না, ধ্বংস করছে প্রজন্মের স্বপ্নও।
অর্থনৈতিক দিক থেকেও গাজা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে। অবরোধের কারণে গাজার শিল্প-কারখানা বা ব্যবসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। মাছ ধরার নৌকা সমুদ্রে যেতে পারে না, কৃষকরা জমি চাষ করতে পারেন না। বেকারত্ব ৫০ শতাংশের বেশি। যারা কাজ পান, তাদের আয় পরিবার চালানোর জন্য যথেষ্ট নয়। অর্থনৈতিক অবরোধ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তীব্র সংকট তৈরি করেছে। গাজার যুবকরা হতাশ হয়ে পড়ছেন, তারা স্বপ্ন দেখার শক্তিও হারিয়ে ফেলছেন।
জাতিসংঘের ভূমিকা বিশেষভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তারা স্বীকার করছে যে গাজায় মানবিক বিপর্যয় ঘটছে, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনা হলেও বারবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেটো ব্যবহার করে ইসরায়েলকে রক্ষা করছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক আইন যেন শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর হাতে একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। দুর্বলদের রক্ষা করার বদলে জাতিসংঘ আজ এক ধরনের রাজনৈতিক নাটকের মঞ্চে রূপ নিয়েছে। বিশ্বনেতাদের ভূমিকাও সমান হতাশাজনক। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশ ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’-এর কথা বলে গণহত্যাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ বাস্তবতা হলো, গাজার সাধারণ মানুষÑ শিশু, নারী, বৃদ্ধÑ তাদের কোনো সামরিক ঘাঁটি নেই, আধুনিক অস্ত্র নেই। তারা কেবল বেঁচে থাকার জন্য লড়ছে। অথচ তাদের ওপর আকাশ থেকে বোমা ঝরানো হচ্ছে। এই দ্বিচারিতা শুধু ইসরায়েলকেই নয়, গোটা মানবসভ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার সতর্ক করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ একাধিক সংস্থা গাজার ওপর ইসরায়েলের হামলাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। তারা বলেছে, বেসামরিক জনগণকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে টার্গেট করা আন্তর্জাতিক আইনের সবচেয়ে বড় লঙ্ঘন। এমনকি কিছু সংস্থা এটিকে গণহত্যার প্রক্রিয়া হিসেবেও অভিহিত করেছে। তবু বিশ্বশক্তির চোখে এসব রিপোর্টের কোনো মূল্য নেই। তাদের কাছে কৌশলগত জোট আর অস্ত্র ব্যবসার হিসাবই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
গণমাধ্যমের ভূমিকাও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক আন্তর্জাতিক মিডিয়া গাজার ভয়াবহ চিত্র প্রচার করলেও কিছু পশ্চিমা মিডিয়া ইসরায়েলের পক্ষে পক্ষপাতদুষ্টভাবে সংবাদ প্রকাশ করছে। তবে সামাজিক মাধ্যম গাজার মানুষের কণ্ঠকে বিশ্বজুড়ে পৌঁছে দিচ্ছে। টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটকে লাখো মানুষ গাজার ভিডিও ও ছবি শেয়ার করছে। এভাবেই বিশ্বজনমত তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে, অনেক দেশে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে, ফিলিস্তিনিদের পাশে থাকার ঘোষণা দিচ্ছে। লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস, জোহানেসবার্গসহ বিশ্বের বড় বড় শহরে গাজা সংহতির মিছিল হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, সরকারগুলো নীরব হলেও জনগণের বিবেক এখনও বেঁচে আছে।
মুসলিম ও আরব দেশগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বিভক্তি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও স্বার্থপরতার কারণে এতদিন তারা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। অথচ গাজার মানুষের প্রতি তাদের নৈতিক দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। কূটনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাদের নেতৃত্ব দিতে হবে। শুধু আবেগ নয়, বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপই পারে গাজার মানুষকে রক্ষা করতে।
প্রশ্ন হলোÑ ইসরায়েলকে থামানো যাবে কীভাবে? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কেবল নিন্দা বা উদ্বেগ যথেষ্ট নয়। অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। অতীতে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী বয়কট কার্যকর হয়েছিল। একই কৌশল এখানে প্রয়োগ করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ভূমিকা বাড়াতে হবে। গাজায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার নিরপেক্ষ তদন্ত জরুরি। দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি না করলে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি আস্থা একেবারে ভেঙে যাবে। যদি আজ গাজায় অপরাধীরা পার পেয়ে যায়, তবে আগামীকাল অন্যত্র একই অপরাধ সংঘটিত হলেও কেউ থামাতে পারবে না।
গণমাধ্যম ও সুশীলসমাজকে আরও সক্রিয় হতে হবে। বিশ্বের মানুষের কাছে গাজার আসল চিত্র পৌঁছে দিতে হবে। মানবিক চাপই একমাত্র শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোকে বাধ্য করতে পারে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে। মুসলিম ও আরব দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তাদের নেতৃত্ব, অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও কূটনৈতিক শক্তি ব্যবহার করতে হবে। শুধু নিন্দা বা শোক প্রকাশে থেমে গেলে চলবে না। বাস্তবসম্মত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই গাজার মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
গাজায় প্রতিদিন যে রক্ত ঝরছে, তা শুধু ফিলিস্তিনিদের নয়, গোটা মানবতার ক্ষত। প্রতিটি শিশুর মৃত্যু, প্রতিটি মায়ের আর্তনাদ আমাদের সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আমরা যদি এখনই জেগে না উঠি, তবে ইতিহাস একদিন সাক্ষ্য দেবে যে আধুনিক সভ্যতার নামে আমরা কেবল নিষ্ঠুরতার বৈধতা দিয়েছি। গাজা আজ সত্যিই মানবাধিকারের সমাধিস্থল। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিবেক না জাগে, তবে মানবাধিকার শব্দটি বইয়ের পাতায় থেকে যাবে, কিন্তু পৃথিবীর কোথাও তার বাস্তব অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
শাহেদ শফিক : প্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক, লন্ডন