ব্যাংকে নারী কর্মী হ্রাস /
সমতা ফেরানো জরুরি
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাত, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে গত এক দশকে নারীর অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে বাড়ছিল, যা ছিল একটি ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তনের নির্দেশক। এ অংশগ্রহণ শুধু সংখ্যা বৃদ্ধির দিক থেকে নয়, বরং দক্ষতা, নেতৃত্ব ও সেবার মান উন্নয়নের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছিল। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা গেছে, ব্যাংক খাতে নারীকর্মীর সংখ্যা হঠাৎ করেই অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে নারীকর্মী কমেছে প্রায় ১,৮৬৭ জন, যার প্রায় পুরোটাই ঘটেছে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে।
এ ধরনের একটি নেতিবাচক প্রবণতা শুধু ব্যাংক খাতের জন্য নয়, বরং দেশের সার্বিক নারী উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান নীতির জন্যও একটি অশনি সংকেত। বিশেষ করে যখন দেশে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিয়ে নানামুখী পরিকল্পনা ও প্রচার চলছে, তখন এই ধাক্কা সরকারের ঘোষণা ও বাস্তবতার মধ্যে একটি পার্থক্যকে সামনে এনে দেয়।
বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই নারী কর্মী হ্রাসের পেছনে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বড় প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তার বক্তব্য অনুযায়ী, আগের সরকার আমলে ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়া অনেকেই, বিশেষ করে নারীকর্মীরা সরকার পরিবর্তনের পর চাকরি হারিয়েছেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে আতঙ্কিত হয়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগও করেছেন। এর ফলে নারীর কর্মসংস্থানে দীর্ঘদিনের পরিশ্রম ও অগ্রগতির একটি বড় অংশ কিছুটা হুমকির মুখে পড়েছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে নারীকর্মীর সংখ্যা ছিল ৩৭,৬৪৯ জন, যা ২০২৫ সালের জুনে এসে কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫,৭৮২ জনে। বিপরীতে পুরুষকর্মীর সংখ্যা কিছুটা বাড়লেও সেটা তুলনামূলক কম এবং সামগ্রিকভাবে এ সময়ের মধ্যে ব্যাংকিং খাতে মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা কমেছে প্রায় ৯৭৮ জন। এ তথ্য থেকেই স্পষ্ট, কর্মী ছাঁটাই বা পদত্যাগের প্রবণতা প্রধানত নারীদের মধ্যেই বেশি দেখা গেছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
এ পরিস্থিতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নারীকর্মীদের মধ্যে স্তরভেদে অংশগ্রহণের পার্থক্য। যেমন- উচ্চপদে নারীর অংশগ্রহণ ১০.২৫ শতাংশে উন্নীত হলেও গত ৬ মাসে প্রারম্ভিক পর্যায়ে নারীর সংখ্য ১৮.৮৭ থেকে কমে ১৭.৬৬ শতাংশে নেমে এসেছে। সংকটের মাঝেও একটি আশার আলো হলো- উচ্চপদে নারীর অংশগ্রহণ কিছুটা বেড়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, নারীকর্মীরা যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ের নিয়োগ হ্রাসের কারণে নারীর এই অগ্রযাত্রা থেমে যেতে পারে; যা নারীর ক্ষমতায়নের বড় বাধা।
এখানে রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথা জোরালোভাবে এসে পড়ে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত দ্রুত এই সংকটের গভীরে গিয়ে এর কারণ খতিয়ে দেখা এবং প্রয়োজনীয় নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। নারীকর্মীদের হঠাৎ চাকরি হারানোর ঘটনা কেবল নিয়োগ প্রক্রিয়ার অনিয়ম বা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে হোক না কেন, এর একটি স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল ব্যাখ্যা জনগণের সামনে উপস্থাপন করা প্রয়োজন।
একই সঙ্গে বেসরকারি ব্যাংকগুলোরও দায়িত্ব হচ্ছে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতানির্ভর কর্মসংস্থান পরিবেশ বজায় রাখা। শুধু উন্নয়নমূলক ভাষণে বা রাজনৈতিক অঙ্গীকারে নয়, বাস্তব নীতিনির্ধারণ, কর্মসংস্থান নিরাপত্তা এবং প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। প্রথমত ব্যাংক ও আর্থিক খাতে নারীদের জন্য আলাদা করে নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন, যেখানে যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ নিশ্চিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর তদারকি থাকতে হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
দ্বিতীয়ত কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য নিরাপদ, নমনীয় ও অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা দীর্ঘমেয়াদি কর্মজীবনে টিকে থাকতে পারেন। মাতৃত্বকালীন ছুটি, করপোরেট ডে-কেয়ার- এসব ব্যবস্থার প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করা উচিত। তৃতীয়ত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে কোটা নয়, বরং নেতৃত্ব গঠনে তাদের প্রস্তুত করতে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও মেন্টরিং প্রোগ্রাম চালু করা উচিত।
সবশেষে বলতেই হয়, নারীকর্মীর উপস্থিতি কেবল একটি সংখ্যা নয়; এটি একটি জাতির অগ্রগতির প্রতিচ্ছবি। সেই প্রতিচ্ছবিকে যেন আমরা নিজের ভুল সিদ্ধান্ত ও অব্যবস্থাপনার কারণে মøান করে না ফেলি, সেটিই এখন সময়ের দাবি।