গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী উত্তরবঙ্গের হিস্যা কোথায়
এই প্রথম বাংলাদেশে একটি বিনিয়োগ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেটি আমরা দেশবাসী স্পর্শ করতে পারছিলাম। বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যানের উপস্থাপনায় টের পাচ্ছিলাম হিমালয়ের পলিতে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের শক্তি। মনে হচ্ছিল, এই প্রথম একটি সরকার পেয়েছি যেখানে আলাদা আলাদা ব্যক্তিকে অভিনন্দিত ও দোষী করা যাচ্ছে। বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান যে একটি জাতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তা অজ্ঞাত ছিলাম। আগে সবকিছুর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দেওয়া হতো।
বিনিয়োগকারীদের সামনে তুলে ধরা হচ্ছিল বাংলাদেশের মানচিত্র। তারা এই প্রথম সারাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন, আমরা টের পাচ্ছি কারা কোথায় বিনিয়োগ করছেন, আমাদের ভাগ্য কোন অঞ্চলে রচিত হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আমরাও স্বদেশকে নতুন করে চিনছি। কিন্তু সেখানে কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাটবাসীর হিস্যা কোথায়? পর্বতের মূষিক প্রসব শেষে চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার নাটকই মনে হচ্ছে।
দুই.
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, পরিবহন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, টেক্সটাইল, মোবাইল টেলিকম, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, লজিস্টিকস, আইটি সেবাসহ বিভিন্ন খাতের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী কমপক্ষে ৩০ জন বিশিষ্ট চীনা বিনিয়োগকারী অংশগ্রহণ করেন সেদিন। এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন মেইনল্যান্ড হেডগিয়ার কোম্পানি লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট পলিন এনগান, যেটি এই খাতে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান।
অধ্যাপক ইউনূস সম্প্রতি বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। প্রেসিডেন্ট শি চীনা শীর্ষ কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। চীনা কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা চট্টগ্রামের চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল ও মোংলায় পরিকল্পিত অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, যেখানে চীন একটি সমুদ্রবন্দর আধুনিকায়ন করবে। বলা হচ্ছে, বিভিন্ন কোম্পানি এরই মধ্যে বাংলাদেশকে তাদের দক্ষিণ এশিয়ার উৎপাদন ও অপারেশন হাবে পরিণত করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘বিনিয়োগ সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছেÑ বাংলাদেশকে নিয়ে এত দিন ধরে যে নেতিবাচক প্রচারণা চলে আসছে, সেটিকে ইতিবাচক করা। বিনিয়োগ সম্মেলনে যেসব ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী এসেছেন, তারা এখানে শ্রমঘন শিল্পে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। আমরাও এই দিকটিকে গুরুত্ব দিই।’
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
তিন.
রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন বিদেশে পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, যা দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করে এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে সহায়ক হয়। তবে এটি আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা বা রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়ার ঝুঁকি থাকে। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের জন্য যে শিল্পায়ন তা স্থানীয় উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে জাগ্রত করে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় স্থানীয় পর্যায়ে, যা অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারকে শক্তিশালী করে। এ ধরনের শিল্পায়ন স্বনির্ভর এবং টেকসই অর্থনীতির জন্য জরুরি। বিদেশি বাজারের ঝুঁকিতেও পড়ে না।
মোদ্দা কথা, রপ্তানিমুখী শিল্প দ্রুত আয় বাড়াতে সাহায্য করে, আর অভ্যন্তরীণ চাহিদাভিত্তিক শিল্প দীর্ঘ মেয়াদে স্বনির্ভর ও টেকসই অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে তোলে। দুটির ভারসাম্যপূর্ণ বিকাশই আমাদের লাগবে।
যেসব খাতে বিনিয়োগের কথা শোনা যাচ্ছে, তাতে ব্রহ্মপুত্রের মূল্যবান খনিজগুলোর ভূমিকা থাকার কথা। নদের বালুতে মূল্যবান ছয়টি খনিজ পদার্থের সন্ধান মিলেছে। বালুর নিচে লুকিয়ে থাকা এসব খনিজ পদার্থ হচ্ছেÑ ইলমেনাইট, রুটাইল, জিরকন, ম্যাগনেটাইট, গারনেট ও কোয়ার্টজ। এসব খনিজের মধ্যে জিকরন সিরামিক, টাইলস, রিফ্যাক্টরিজ ও ছাঁচ নির্মাণে ব্যবহার করা হয়। রঙ, প্লাস্টিক, ওয়েল্ডিং রড, কালি, খাবার, কসমেটিকস, ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় রুটাইল। শিরিশ কাগজ উৎপাদনে ব্যবহার হয় গারনেট। চুম্বক, ইস্পাত উৎপাদনসহ বিভিন্ন কাজে লাগে ম্যাগনেটাইট। টিটেনিয়াম মেটাল, ওয়েল্ডিং রড ও রঙ উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয় ইলমেনাইট। আর কাচশিল্পের অন্যতম কাঁচামাল কোয়ার্টজ।
ইনস্টিটিউট অব মাইনিং, মিনারেলজি অ্যান্ড মেটালার্জির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চিলমারীতে খনিজ বালু প্রসেসিং সেন্টার স্থাপন করা হলে সেখান থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৫০০ টন খনিজ পাওয়া সম্ভব। জয়পুরহাটের খনিজ প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে বিভিন্ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রতি টন বালু থেকে ২ কেজি ইলমেনাইট, ২০০ গ্রাম রুটাইল, ৪০০ গ্রাম জিরকন, ৩.৮ কেজি ম্যাগনেটাইট, ১২ কেজি গারনেট ও ৫০ কেজি কোয়ার্টজ মিনারেল পাওয়া গেছে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
এদিকে এভারলাস্ট লিমিটেড নামের অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানিটি বেশ কিছুদিন ধরে গাইবান্ধা সদর ও ফুলছড়ি উপজেলায় যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের ৪ হাজার হেক্টর বালুচরে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানের কাজ করছে। বালাসীঘাট এলাকায় একটি প্লান্টও স্থাপন করছে প্রতিষ্ঠানটি। এবার ফুলছড়ির বালাসীঘাট, সদরের মোল্লারচর এবং কামারজানি এলাকায় ২ হাজার ২৯৫ হেক্টর বালুচর লিজ চেয়ে খনিজ আহরণের আবেদন করেছে প্রতিষ্ঠানটি, যেখানে আহরণের পর সরকারকে ৪৩ শতাংশ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে তারা।
গবেষণার জন্য কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ভূমিকা নিতে পারে। অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ, ভবন নির্মাণ বাবদ এক টাকাও বরাদ্দ নেই। চিলমারীর রমনায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সীমানা দেওয়া হয়েছিল, তারও কোনো খবর নেই।
ড. ইউনূস বারবার সেভেন সিস্টার্সের ল্যান্ড লকডের প্রসঙ্গ টানছেন। সেভেন সিস্টার্সে রপ্তানি করতে গেলে উত্তরবঙ্গে বিনিয়োগ লাগবে। কুড়িগ্রামের সঙ্গে পশ্চিম বাংলা, আসাম ও মেঘালয়ের সীমানা। রৌমারী ও সোনাহাট স্থলবন্দর, চিলমারী নদীবন্দর, লালমনিরহাটের বুড়িমারী স্থলবন্দর আছে। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম যে ঘুরিয়ে আনবেন, সেই বিমান যোগাযোগ কই? লালমনিরহাট বিমানবন্দরটি পরিত্যক্ত, হাসিনা-ভারতের আপত্তিতে বিমানবন্দরের কাজ আর এগোয়নি। সৈয়দপুর বিমানবন্দর সৈয়দপুর ইপিজেড গড়ে তুলেছে। বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুরজুড়ে এত বড় ভাওয়াইয়া এলাকা। অথচ ভাওয়াইয়া ইনস্টিটিউট হলো না। আসিফ নজরুল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছাড়ার পর মন্ত্রণালয়ের কাজ ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে ২৬ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হওয়ার কথা ছিল। রংপুর বিভাগের নার্সিং ইনস্টিটিউটগুলোতে ভাষা শিক্ষার আয়োজন কই? বিনিয়োগ মানচিত্রে রংপুর কই? পর্যটন খাতে ব্রহ্মপুত্র ও শেরপুরের পাহাড় কই? দারিদ্র্যের শীর্ষে থাকা রংপুর বিভাগের হিস্যা নেই।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
নাহিদ হাসান : কবি, লেখক ও সংগঠক