সংস্কৃতির জীবন্ত দলিল

সুপ্রতিম বড়ুয়া
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সংস্কৃতির জীবন্ত দলিল

নৌকাবাইচ বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি অংশ। বর্ষায় এই জনপদে নৌকাবাইচ আনন্দ উৎসবে পরিণত হয়। এটি একই সঙ্গে উৎসব ও জনপ্রিয় একটি খেলা। নৌকাবাইচের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ধারণা করা হয়, নদীপথে যাতায়াতের পাশাপাশি যুদ্ধবিদ্যা ও ক্রীড়াচর্চার অংশ হিসেবেও এ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদে ঈদ, পূজা বা হেমন্তের নবান্ন উৎসবকে ঘিরে নৌকাবাইচ আয়োজনের রেওয়াজ ছিল প্রবল। নদীর দুই তীরের মানুষ তখন একত্র হয়ে বৈঠিয়ালদের গান, স্লোগান আর বৈঠার ঝাপটায় প্রাণের উচ্ছ্বাস খুঁজে পেত। আজকের প্রেক্ষাপটে নৌকাবাইচ কেবল গ্রামীণ উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দর্শক টানে। সরকার ও স্থানীয় প্রশাসন নিয়মিত এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে, যা পর্যটনশিল্পের জন্যও ইতিবাচক। বিশেষ করে পদ্মা, যমুনা কিংবা মেঘনার মতো বড় নদীতে আয়োজিত প্রতিযোগিতা স্থানীয় অর্থনীতিতে সজীবতা আনে। হাটবাজার জমে ওঠে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা লাভবান হয়। সময়ের বিবর্তনে আর কালের পথপরিক্রমায় নদীমাতৃক বাংলার নৌকাবাইচের সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও সাম্প্রতিক কয়েক বছর ধরে, হাজার বছরের গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে আবার তা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। নদনদী, বিল-হাওরের এই দেশের লোক-ঐতিহ্য প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতায় গতি ও কর্মোদ্যমের জন্য যে গান গীত হয়, তা লোকসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। নৌকাবাইচের গানকে সারিগান বা হাইড় বলা হয়। নৌকাবাইচের জন্য নির্মিত হয় বিশেষ ধরনের নৌকা। অঞ্চলভেদে এগুলোর আকৃতি ও নাম বিভিন্ন। বাইচের নৌকার গঠন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। নৌকার সামনের গলুই খুব সুন্দর করে সাজানো থাকে। তাতে কখনও থাকে ময়ূরের মুখ, কখনও রাজহাঁস কিংবা অন্য কোনো পাখির মুখ। নৌকাটিতে উজ্জ্বল রঙের কারুকাজ করে বিভিন্ন নকশা তৈরি করা হয় দর্শকের সামনে যথাসম্ভব আকর্ষণীয় করার জন্য। নৌকা তৈরিতে শাল, কড়ই, গর্জন ইত্যাদি কাঠ ব্যবহার করা হয়। নদীতে নৌকাবাইচের আয়োজন করা হলে তীরে জমে যায় অসংখ্য লোক। আর রামুর বাঁকখালী নদীতে নৌকাবাইচ উৎসবে হাজার হাজার মানুষ ডিঙি নৌকা নিয়ে জড়ো হয়। মিয়ানমার থেকে উৎপত্তি এই বাঁকখালী নদীতে শুধু নৌকা আর নৌকা এবং দর্শনার্থীদের ভিড়। করতালিমুখরিত ফুটবল খেলার মাঠের মতো বাঁকখালী নদীর বুকে জয়ধ্বনিতে ফেটে পড়ে। প্রতিযোগিতা শুরুর আগের দৃশ্যটি অত্যন্ত উপভোগ্য। শক্তি ও নৈপুণ্য প্রদর্শনীর মহড়া এবং নৌকাগুলোর ফেরির দৃশ্য হয় চমৎকার। গান চলছে, বাদ্যযন্ত্র বাজছে, সুঠামদেহী মাল্লারা ধুয়া ধরছে, গানের তালে তালে বৈঠা ঘুরিয়ে পেছন ভাগ ঠুকছে গোড়ায়, পানি উড়ছে ফেনার মতো, চারদিকে চলছে হাততালি। এক সময় শুরু হয় প্রতিযোগিতা। সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। যে নৌকা সীমা পেরিয়ে আগে যাবে, জয় হবে তার। চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে দর্শকের মাঝে। শুধু ঝপঝপ বৈঠার শব্দ আর মারো টান হেইও, আরও জোরে হেইও! সেই সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি। সব মিলিয়ে চরম উত্তেজনাপূর্ণ এবং উপভোগ্য দৃশ্য।

প্রতিবছর কক্সবাজার জেলার রামু অঞ্চলের গ্রামের তরুণ-যুবকরা রামুর বাঁকখালী নদীর নিকটবর্তী মানুষরা বর্ষা শেষে নৌকাবাইচের আয়োজন করেন। প্রতিবছরের শরৎকালে এই অঞ্চলের জনগণ নৌকা নিয়ে বাঁকখালী নদীতে বিভিন্ন রংবেরঙের নৌকা নিয়ে নৌকাবাইচে হাজির হতে থাকেন। প্রতিটি আয়োজনে অংশ নেওয়ার আগে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। কারা অংশ নেবেন, কে সারি গাইবেন, কে হাল ধরবেন, বাইছালদের (মাঝি) পোশাক কী হবে, কারা বাদ্যযন্ত্র বাজাবেনÑ এ রকম প্রস্তুতি চলে সপ্তাখানেক। বাঁকখালী নদীতে কয়েকদিন ধরে চলে মহড়া। তারপর ‘এসো এসো বন্ধুগণ নাও দৌড়াইতে যাই, সারি গাইয়া বাইছালী খেলাই’Ñ গানের তালে তালে, কখনও বা বাউল শাহ আবদুল করিমের ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইল কেমন দেখা যায়, ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খি নায়’ গাইতে গাইতে হাওরে ঢেউ তুলে মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাকে। বাইছালদের মুখে মুখে ‘শাবাশ শাবাশ, হেঁইয়ো’ জোশে সামনে এগোয় ‘ময়ূরপঙ্খি’। সেই জোশের তালে জোরসে বাইছালদের উৎসাহ দেন বাঁকখালী পারের হাজারো দর্শক। প্রতিযোগিতায় পুরস্কার নিয়ে বাড়ি ফেরেন, অনেক বাইছালি খালি হাতেই ফেরেন। তারপরও আনন্দের কোনো কমতি তাদের থাকে না। সামাজিক নানা উদ্যোগে ব্যস্ত থাকলেও তাদের সবার মনোযোগের কেন্দ্রে থাকে বর্ষা শেষে নৌকাবাইচে। তাই শতবর্ষের রামুর ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ এখন শুধু একটি প্রতিযোগিতার নাম নয়, রামুর মানুষের একাত্মতার প্রতীক, সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। নৌকাবাইচ এখনও আমাদের গ্রামীণ সমাজের প্রাণবন্ত ঐতিহ্য। এটি মানুষকে একত্র করে, সমাজে মিলনমেলার আবহ তৈরি করে, আর তরুণ প্রজন্মকে শিকড়ের সঙ্গে পরিচিত করে। নৌকাবাইচ কেবল ক্রীড়া নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতির জীবন্ত দলিল।


সুপ্রতিম বড়ুয়া : প্রাবন্ধিক ও অবসরপ্রাপ্ত (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যক্ষ, রামু সরকারি কলেজ