সৎকর্মও ইবাদত

ইকরামুল ইসলাম
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
সৎকর্মও ইবাদত

ইবাদত ও খেলাফত- এ দুটি বিষয় সামনে রেখে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত জাতি হিসেবে মনোনীত ও পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জিন জাতি সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে কোনো রকম রিজিক চাই না এবং এটাও চাই না যে, তারা আমাকে খাবার দিক। আল্লাহ নিজেই তো রিজিকদাতা এবং তিনি প্রবল পরাক্রমশালী।’ (সুরা জারিয়াত : ৫৬-৫৮)

আমরা সাধারণত ইবাদত বলতে কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, তালিম-তাজকিয়াহ, জিকির-আজকার ইত্যাদিকে বুঝে থাকি এবং অনেক সময় নিজেদের এসবের মাঝে লিপ্ত ও সীমাবদ্ধ রাখতে পছন্দ করি। আর এর বাইরে যাওয়া মোটেও সমীচীন মনে করি না। কিন্তু ইসলাম আমাদের আরও বিস্তর ও বিশালতার দিকে আহ্বান করেছে। উদ্দেশ্য ও নিয়তকে পরিশুদ্ধ রেখে মুমিনের যেকোনো কাজই ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়। ইসলাম তার আবশ্যিক বিধানাবলি পালনের পর অর্থোপার্জন, পারিবারের ব্যয় নির্বাহ এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতঃপর নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা জুমা : ১০)

হজরত মিকদাদ (রা.) বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মানুষ যে খাবার খায় তার মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ও উৎকৃষ্ট হলো নিজ হাতের উপার্জিত খাবার। আল্লাহর নবী দাউদ আ. নিজ হাতে উপার্জিত খাবার খেতেন।’ (সহিহ বোখারি : ২০৭২)

অন্যের মুখাপেক্ষিতা, পরনির্ভরশীলতা ও ভিক্ষাবৃত্তি সম্মানের কোনো বিষয় নয়; এটা বিশ^মানবতার জন্য চরম অভিশাপ। ইসলাম এ ব্যাপারে মানুষকে নিরুৎসাহিত করেছে এবং স্বনির্ভরতার প্রতি উৎসাহ দিয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কারও পক্ষে এক বোঝা লাকড়ি সংগ্রহ করে পিঠে বহন করে নেওয়া কারও কাছে কিছু চাওয়ার চেয়ে উত্তম। অনেক সময় চাইলে সে দিতেও পারে, আবার না-ও দিতে পারে।’ (সহিহ মুসলিম : ১০৪২)

বর্তমানে মুসলমান খেলাফতশূন্য এক জাতিতে পরিণত হয়েছে। অথচ পৃথিবীতে খেলাফত বা আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করার প্রকৃত হকদার তারাই। অলসতা, কর্মহীনতা, বেকারত্ব, পরাধীনতা, বিলাসিতা ও আরামপ্রিয়তা আজ তাদের ওপর জেঁকে বসেছে। বিকারগ্রস্ত হয়েছে তাদের চিন্তা-চেতনা, বিবেক ও বিবেচনাবোধ। সর্বক্ষেত্রে অন্যের মুখাপেক্ষী ও পরনির্ভরশীলতা তাদের মন-মগজ, জীবন ও চরিত্রের সঙ্গে মিশে গেছে। আর এ কারণেই প্রতিনিয়ত লাঞ্ছনা-বঞ্চনা ও অপমান-অপদস্থের স্বীকার হতে হচ্ছে তাদের। বিবর্জিত হচ্ছে তাদের আত্মসম্মান ও চেতনাবোধ। অথচ ইসলাম তাদের কর্ম-উদ্যমতা, শক্তি সঞ্চয়, কায়িক শ্রম ও সংগ্রামের মাধ্যমে সম্মান-সমৃদ্ধি ও মর্যাদার জীবনের প্রতি উৎসাহ দিয়েছে এবং পরনির্ভরশীলতা ও অন্যের কাছে হাত পাততে নিরুৎসাহিত করেছে। হজরত সাওবান (রা.) বর্ণিত, একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘কে আছ, যে আমাকে নিশ্চয়তা দেবে- সে অন্যের কাছে কোনো কিছু চাইবে না, তাহলে আমি তার জান্নাতের জিম্মাদার হব? সাওবান (রা.) বললেন, আমি; এরপর তিনি কারও কাছে কিছু চাইতেন না।’ (সুনানে আবু দাউদ : ১৬৪৩)

পরনির্ভরশীলতা একদিকে জাতিকে যেমন কর্মহীনতা ও কুফরির দিকে ঠেলে দেয়, অন্যদিকে অন্যের বশ্যতা মেনে নিতে বাধ্য করে। বিশ^ মুসলিম সমাজ আজ এমনই অবস্থা ও বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। পবিত্র কোরআন-সুন্নাহ থেকে তারা অনেক দূরে সরে গেছে। স্বজাতির সঙ্গে শতধাবিভক্তিতে জড়িয়ে পড়েছে। অমুসলিমদের পরম বন্ধু ও হিতাকাক্সক্ষী হিসেবে গ্রহণ করেছে। ফলে বিপদাপদ, অপমান ও লাঞ্ছনা তাদের পিছু ছাড়ছে না।

জাতির এই ক্রান্তিকালে মুসলমানদের স্বমহিমায় ফিরে আসতে- তাদের নব উদ্যমে উঠে দাঁড়াতে হবে। পবিত্র কোরআন-সুন্নাহকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। জাতীয় ঐক্যসাধনে স্বজাতির মাঝে সৌহার্দ-সম্প্রীতি ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। উম্মাহর জিম্মাদারি নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে হবে। ব্যক্তিজীবন থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে চাতুর্যের পরিচয় দিতে হবে। শত্রুর মোকাবিলায় নিজেদের যথাযোগ্যভাবে প্রস্তুত করতে হবে এবং চতুর্মুখী শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তাদের (কাফিরদের) মোকাবিলার জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত কর, তা দ্বারা তোমরা ভয় দেখাবে আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদের এবং এরা ছাড়া অন্যদেরও, যাদের তোমরা জান না, আল্লাহ তাদের জানেন। আর তোমরা যা আল্লাহর রাস্তায় খরচ কর, তা তোমাদের পরিপূর্ণ দেওয়া হবে এবং তোমাদের ওপর জুলুম করা হবে না।’ (সুরা আনফাল : ৬০)

হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘মুশরিকদের বিরুদ্ধে নিজেদের সম্পদ, জীবন ও কথার মাধ্যমে জিহাদ করো।’ (সুনানে আবু দাউদ : ২৫০৪)


ইকরামুল ইসলাম : ইমাম, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিসৌধ পার্ক জামে মসজিদ, ঝিনাইদহ