হিটলার-মুসোলিনির অপচ্ছায়া নেতানিয়াহু
ইসরায়েলি বাহিনী প্রতিদিন হামলা চালাচ্ছে ফিলিস্তিনের গাজায়। তাদের হামলায় নিহত হচ্ছে গাজার নিরীহ ও অসহায় নারী-শিশু-পুরুষ। এক টুকরো খাবার আর একটু নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে তারা এদিক-ওদিক ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত। পৈশাচিক এসব হামলা বন্ধ বা হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। মানবাধিকারকর্মী, লেখক, নোবেলজয়ী, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও শান্তিপ্রিয় মানুষের যুদ্ধ বন্ধের সব আহ্বানে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গাজায় জাতিগত নিধন চালিয়েই যাচ্ছে ইসরায়েল। মানবতাবিরোধী এই অপরাধের প্রধান নির্দেশদাতা হচ্ছেন জায়নবাদ ও ইহুদি শ্রেষ্ঠত্ববাদের কট্টর সমর্থক, যুদ্ধবাজ, মধ্যপ্রাচ্যের কসাই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। যার কাছে মানুষের জীবন ও মানবাধিকার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের বিষয়; যার ভেতর হিটলার ও মুসোলিনির অপচ্ছায়া স্পষ্ট।
গাজার চলমান গণহত্যাকে অনেকেই হিটলারের নাৎসি বাহিনীর চালানো হলোকাস্টের সঙ্গে তুলনা করা শুরু করেছেন। ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার উগ্র জাতীয়তাবাদী সদস্য ও তাদের নেতা নেতানিয়াহু গাজায় একের পর এক ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনার অনুমোদন দিয়ে চলেছেন; প্রতিনিয়ত আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছেন। গাজার অভুক্ত কঙ্কালসার শিশুদের ছবিও তার মনকে নাড়া দিতে পারেনি। এর ফলাফল ও গাজাবাসীর ভবিষ্যৎ কেবল সময়ই বলতে পারবে।
ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের ঠিক এক বছর পর ১৯৪৯ সালে নেতানিয়াহুর জন্ম তেল আবিবের একটি আশকেনাজি ইহুদি পরিবারে। তিনি পশ্চিম জেরুজালেম ও যুক্তরাষ্ট্রে বড় হয়েছেন। তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি আত্মপ্রেমী, অহংকারী, বিকারগ্রস্ত; চাপে থাকলে বাজেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখান আর ঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তিনি একগুঁয়ে স্বভাবের ও যুদ্ধবাজ প্রকৃতির। তিনি পরিবার ছাড়া কাউকে বিশ^াস করেন না। অন্য সবকিছুর চেয়ে নিজের ভবিষ্যৎকেই অগ্রাধিকার দেন। তাই দুর্নীতির বিচার থেকে বাঁচতে ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ার টিকিয়ে রাখতে তিনি লাখো ফিলিস্তিনির জীবন নিয়ে খেলছেন। এমনকি তার কাছে হামাসের হাতে জিম্মি নিজের দেশের নাগরিকদের জীবনেরও মূল্য নেই। তাদের ফিরিয়ে আনা ও যুদ্ধ বন্ধের ইসরায়েলবাসীর দাবি তিনি লাগাতার উপেক্ষা করে চলেছেন। যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুর মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্তরাষ্ট্রও দোসর হিসেবে কাজ করছে। ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করতে নেতানিয়াহুর মাথার ওপর ছাতা ধরে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।
ব্যক্তিজীবনে তিন সন্তানের জনক নেতানিয়াহু। বর্তমান স্ত্রী সারার আগেও তিনি আরও দুবার বিয়ে করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে অনৈতিক সম্পর্কেরও অভিযোগ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে স্নাতক নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক জীবনে অনেকবার উত্থান-পতন ঘটেছে। তিনি ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাছাড়া তিনি নেসেটের সদস্য এবং লিকুদ পার্টির সভাপতি। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং জাতিসংঘে ইসরায়েলের দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ফিলিস্তিনিদের দমন করতে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী ইনস্টিটিউট গড়েছেন। সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন কয়েকবার।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
কেউ কেউ বলে থাকেন, নেতানিয়াহু তার ক্যারিশম্যাটিক দক্ষতা দেখিয়ে দীর্ঘদিন ইসরায়েলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কয়েকটি মুসলিম দেশের সঙ্গে আব্রাহাম অ্যাকর্ড স্বাক্ষরকে নিজের কৃতিত্ব হিসেবে জাহির করেন। তবে এ ক্ষেত্রে তার বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকাই মুখ্য। ইসরায়েলের সবচেয়ে উগ্র ও জায়নবাদী ভোটাররাই নেতানিয়াহুর প্রধান শক্তি। এসব বর্ণবাদী ভোটারই সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। নেতানিয়াহুর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে অসংখ্য ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত শুধু গাজাতেই ৬৫ হাজারের মতো ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। তবে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, এ সংখ্যা দ্বিগুণ বা তিনগুণ। এ ছাড়া অনাহারে প্রতিনিয়ত শিশুরা মারা যাচ্ছে। ইসরায়েলি কারাগারে বন্দি আছে বহু ফিলিস্তিনি, তাদের ওপর চালানো হয় পদ্ধতিগত নির্যাতন।
ফিলিস্তিনের অপর অংশ পশ্চিম তীরের বাড়িঘর-দোকানপাট ও জলপাই বাগান ধ্বংস, সম্পত্তি দখল ও নিপীড়ন চলছেই। লেবানন, ইয়েমেন, সিরিয়ায় খেয়ালখুশিমতো হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী নেতানিয়াহুর নির্দেশে। এর আগে অন্য কোনো ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইরানে হামলার সাহস না দেখালেও তিনিই প্রথম এ কাজ করেছেন। যদিও এ হামলা চালাতে গিয়ে সুবিধা করতে পারেননি। ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোমের সক্ষমতা প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন তিনি।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা পুরোপুরি ধ্বংস করার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছেন নেতানিয়াহু। পশ্চিম তীর ও গাজাকে পুরোপুরি ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত করার পরিকল্পনার পাশাপাশি আরও একটি খায়েশের কথা সম্প্রতি প্রকাশ্যেই বলেছেন তিনি। সেটি হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের আরও অনেক অংশ দখলের মাধ্যমে গ্রেটার ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করা। আরব নেতারা অবশ্য তার এ মনোভাবের কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তবে তাদের প্রতিক্রিয়া শুধু বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ; কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। আরব নেতারা উগ্র জায়নবাদীদের অভিলাষ ঠেকাতে না পারলে ভবিষ্যতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যই চলে যাবে ইসরায়েলের গ্রাসে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
এটি স্পষ্ট যে, নেতানিয়াহু ক্রমেই জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলারের মতোই রক্তপিপাসু এবং ইতালির সাবেক একনায়ক বেনিতো মুসোলিনির মতো ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছেন। একদিকে তিনি নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের জীবন ও সম্পদহানিতে মেতেছেন, আরেকদিকে বিচার বিভাগসহ ইসরায়েলের প্রশাসনে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন এবং তার অনুগতদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাচ্ছেন। মতের অমিল হওয়ায় সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্যালান্টকেও তিনি ছুড়ে ফেলেছেন। অনেক বিশ্লেষকের আশঙ্কা, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে বৃহত্তর যুদ্ধ ডেকে আনছেন, অনেক পরাশক্তিও এতে জড়িয়ে পড়তে পারে।
নেতানিয়াহুর কর্মকাণ্ডে তার ইসরায়েলেই সমালোচনার ঝড় বইছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, তার অস্থির মস্তিষ্ক ও বেপরোয়া আচরণ ইসরায়েল ধ্বংসের কারণ হতে পারে। এরই মধ্যে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) নেতানিয়াহুর ওপর বিরক্তি প্রকাশ করেছে। দেশটির আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একঘরে হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। বেশ কিছু দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে নেতানিয়াহু এসব নিয়ে চিন্তিত বলে মনে হয় না। ফিলিস্তিনি নারী-বৃদ্ধ-শিশুদের রক্তে হাত রাঙাতেই তিনি ব্যস্ত।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
জুয়েল জনি : সহ-সম্পাদক, আমাদের সময়
মতামত লেখকের নিজস্ব