দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক বিপ্লব ও ভবিষ্যতের ভূরাজনীতি
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ও খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী থমাস জেফারসন বলেছেন, ‘যখনই শাসক জনগণের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে, তখনই বিপ্লবের অধিকার পবিত্র হয়ে ওঠে।’
বিপ্লব কোনো হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঝড় নয় বরং এটি জন্ম নেয় দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, অবিচার ও অসন্তোষ থেকে। যখন জনগণ প্রত্যক্ষ করে তারা তাদের মৌলিক চাহিদাÑ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ থেকে বারবার উপেক্ষিত হচ্ছে, তখন ক্ষোভ সঞ্চিত হয়ে বিস্ফোরণে রূপ নেয়। রাষ্ট্র যখন আর জনগণের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম থাকে না, তখনই তারা নিজেরাই পরিবর্তনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ইতিহাস বলে, বিপ্লব শুধু ক্ষমতার পালাবদল নয়, বরং একটি জাতির নতুন পথচলার সূচনা। এটি মানুষের কণ্ঠস্বরের এমন এক গর্জন, যা কোনো দমন বা নিপীড়নে জাতীকে চিরদিন স্তব্ধ রাখতে পারে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের সূচনা হয়েছে জনগণের বঞ্চনা, বৈষম্য ও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা থেকে। ফরাসি বিপ্লব থেকে আরব বসন্ত পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ার পথে দিকনির্দেশ করেছে। এসব বিপ্লব দেখিয়েছে, শাসক নয়, জনগণই ইতিহাসের প্রকৃত চালিকাশক্তি।
দক্ষিণ এশিয়া সব সময়ই রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক আন্দোলন এবং ভূরাজনৈতিক টানাপড়েনের জন্য আলোচনায় থাকে। এ অঞ্চলের প্রতিটি দেশের ইতিহাসের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে নানা ধরনের গণ-অভ্যুত্থান, বিপ্লব কিংবা আন্দোলন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানকে ঘিরে যেসব পরিবর্তন ঘটেছে, সেগুলো কেবল স্থানীয় প্রেক্ষাপটেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর প্রভাব পড়ছে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যে। এ ধরনের আন্দোলন শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতির রূপই বদলাচ্ছে না, বরং ভারত-পাকিস্তানসহ বড় শক্তিগুলোর কৌশলগত অবস্থানকেও নতুনভাবে সাজাতে বাধ্য করছে।
নেপালের উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে উত্তরণের পর নেপাল এক নতুন রাজনৈতিক কাঠামোতে প্রবেশ করে। কিন্তু গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব, দলীয় দ্বন্দ্ব এবং দুর্নীতির কারণে দেশটিতে একের পর এক অস্থিরতা তৈরি হয়। সাম্প্রতিক সময়ের তরুণ নেতৃত্বাধীন আন্দোলন প্রমাণ করেছে, জনগণ আর পুরনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তে সন্তুষ্ট নয়। তারা চায় পরিবর্তন, স্বচ্ছতা এবং অংশগ্রহণ। এই আন্দোলন শুধু নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দিকেই নতুন দিগন্ত খুলে দেয়নি, বরং ভারত ও চীনের মতো আঞ্চলিক শক্তিকেও তাদের কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে। কারণ নেপাল ভৌগোলিকভাবে যেভাবে দুই বৃহৎ শক্তির মাঝে অবস্থান করছে, সেখানে সামান্য পরিবর্তনও আঞ্চলিক ভূরাজনীতিকে নড়বড়ে করে তুলতে পারে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থান দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আলোচিত ঘটনাপ্রবাহ। চাকরির কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া এই আন্দোলন খুব দ্রুত জাতীয় আন্দোলনে রূপ নেয়। তরুণ প্রজন্মের এই জাগরণ সরকারকে চাপে ফেলে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্রসমাজ সব সময়ই গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে আর এবারের আন্দোলন তারই ধারাবাহিকতা। তবে পার্থক্য হলো, এবার আন্দোলনের পেছনে ডিজিটাল যোগাযোগ, সামাজিক মাধ্যম এবং এক নতুন প্রজন্মের শক্তিশালী উপস্থিতি। এই ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশকে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যেখানে জনগণের অংশগ্রহণ এবং স্বচ্ছতার দাবিকে উপেক্ষা করা যাবে না। ভারতের জন্য এটি এক বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সরাসরি সীমান্ত নিরাপত্তা, বাণিজ্য এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, যা ইতোমধ্যে অনেকটাই দৃশ্যমান। চব্বিশের আন্দোলনে ভারতের নেতৃত্ব ও আধিপত্যের প্রতি জনগণের জিরো টলারেন্স নীতি অভ্যুত্থানের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক কূটনীতি, বাণিজ্যিক চুক্তি এবং সীমান্ত সহযোগিতার মাধ্যমে ভারতের প্রভাব দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতিতে দৃশ্যমানভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। জনগণ তা আর গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। এ দেশের মানুষ এটা সরাসরি প্রকাশ করেছে যে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে চায়। কিন্তু ইতিপূর্বে বিদেশি প্রভাব দেশীয় গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
এ দেশের মানুষের ভারতবিরোধী মনোভাব শুধু রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতায় সীমাবদ্ধ হয়নি; এটি আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ধর্মীয় প্রথার ওপরও প্রভাব বিস্তার করেছে। মানুষ দেশীয় ঐতিহ্য, ভাষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের স্বীকৃতি ও সংরক্ষণের জন্য আন্দোলন করেছে। ফলে চব্বিশের অভ্যুত্থান কেবল সরকারের নীতি ও দুর্নীতির প্রতিবাদই ছিল না, বরং এটি জাতীয় সার্বভৌমত্ব, সাংস্কৃতিক মর্যাদা ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতি জনগণের শক্তিশালী সংরক্ষক মনোভাবের প্রতিফলন হিসেবেও প্রমাণ করেছে। ফলে পাকিস্তানও এই পরিস্থিতিকে তাদের কূটনৈতিক স্বার্থে এবং ঐতিহাসিক দ্বিচারিতা ভুলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও বেগবান করতে চাইবে, যেটিও এখন দৃশ্যমান।
অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার আরাগালয়া আন্দোলন পুরো বিশ্বকেই চমকে দিয়েছে। তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, খাদ্য ও জ্বালানি ঘাটতি এবং ঋণের বোঝা সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করে। বছরের পর বছর দুর্নীতি, অপব্যবহার আর অব্যবস্থাপনার ফলে জনগণ রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে, যা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকশের পদত্যাগে গড়ায়। শ্রীলঙ্কার এই অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে, যখন অর্থনীতি ধসে পড়ে তখন রাজনৈতিক ক্ষমতাও ভেঙে পড়ে। আর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশও বুঝে গেছে, যদি জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা না যায় তবে যেকোনো সরকারই রাস্তায় নামা জনতার কাছে পরাস্ত হতে বাধ্য হবে। এই প্রেক্ষাপটে ভারত শ্রীলঙ্কাকে বাঁচাতে অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিলেও চীনও সেখানে তাদের প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলে দ্বীপরাষ্ট্রটি এখন হয়ে উঠেছে ভারত-চীন প্রতিযোগিতার এক নতুন মঞ্চ।
মালদ্বীপের রাজনীতি তুলনামূলক ছোট আকারের হলেও এর প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার সমুদ্র নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থে বিশাল। ভারত মহাসাগরের মাঝামাঝি অবস্থানের কারণে মালদ্বীপকে ঘিরে বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা সব সময় তীব্র। গেল বছরগুলোতে দেশটিতে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। সেখানকার সরকার পরিবর্তন এবং পররাষ্ট্রনীতির দোলাচলÑ কখনও ভারতঘেঁষা, কখনও চীনঘেঁষাÑ মালদ্বীপকে আঞ্চলিক ভূরাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত করেছে। সেখানকার নাগরিক আন্দোলনও এই প্রভাবশালী শক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করছে। সর্বশেষ মুইজ্জু সরকারের ভারতবিরোধী নীতি চীনকে প্রধান সুযোগ দিয়েছে; পাশাপাশি পাকিস্তান, তুরস্ক ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ মালদ্বীপে প্রভাব বিস্তারের কৌশলগত সুযোগ পেয়েছে, যা মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও বেগবান করেছে।
আফগানিস্তানের প্রেক্ষাপট দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন। ২০২১ সালে তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় এলে দেশটি এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করে। তবে নারী অধিকার কিছুটা সংকুচিত হওয়া, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হ্রাস পাওয়া এবং তাৎক্ষণিক সময়ের জন্য অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দেশটির জনগণকে কিছুটা হতাশ করলেও তারা দৃঢ়ভাবে ঘুরে দাঁড়ায়। নারীদের অধিকারের প্রশ্নে তারা প্রতিবাদ করেছে, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে কণ্ঠ তুলছে। আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে ভারত, পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রতিযোগিতা নতুন করে তীব্র হচ্ছে। বিশেষ করে পাকিস্তান আফগানিস্তানের পরিবর্তনকে তার নিরাপত্তানীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে মনে করে, আর ভারত সেখানে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতাকে নাড়া দেয়।
এখন প্রশ্ন হলো, এই আন্দোলনগুলো বা গণ-অভ্যুত্থানগুলো দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ ভূরাজনীতিকে কোন দিকে নিয়ে যাবে? প্রথমত, জনগণ স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে তারা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার আর সহ্য করতে রাজি নয়। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার সরকারগুলোকে জনগণের কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, এসব আন্দোলন বড় শক্তিগুলোর ভূমিকাকে আরও জটিল করে তুলবে। ভারত চাইবে প্রতিবেশী দেশগুলোতে স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক, যাতে তার সীমান্ত নিরাপদ থাকে এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়। এই সুযোগে মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানও তার সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার চেষ্টা করবে। তৃতীয়ত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও এই শূন্যতায় প্রভাব বিস্তার করতে চাইবে। ফলে ভবিষ্যতের ভূরাজনীতি হবে বহুমাত্রিক, যেখানে ছোট ছোট দেশগুলোও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
সব শেষে বলা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থান ও আন্দোলনগুলো প্রমাণ করছে যে, এ অঞ্চলের জনগণ আর নিছক দর্শক নয়। তারা চাইছে তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, রাজনৈতিক স্বচ্ছতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। এই চাহিদাগুলো যদি পূরণ না হয় তবে যেকোনো সময় আবারও বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। আর এই বিস্ফোরণ শুধু একটি দেশের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকবে না; এর ঢেউ ছড়িয়ে পড়বে গোটা অঞ্চলে, এমনকি বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতেও। দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ তাই নির্ভর করবে জনগণের প্রত্যাশা মেনে নেওয়া এবং আঞ্চলিক সহযোগিতাকে এগিয়ে নেওয়ার ওপর। নচেৎ অস্থিরতার আগুনে পুড়তে থাকবে এই জনবহুল ও সম্ভাবনাময় অঞ্চল।
সুলতান মাহমুদ সরকার : এমফিল গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক, গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড
আরও পড়ুন:
মার্কিন শ্রমনীতি দেশের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য?