ফরিদা পারভীন : এক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি
ফরিদা পারভীন লালন, পল্লী ও আধুনিক গীতির এক অনন্য শিল্পী। তার গায়কী ভঙ্গি, জাদুকরী কণ্ঠে বাণীর প্রক্ষেপণ ছিল হৃদয়স্পর্শী। এই পৃথিবীর আলো-ছায়া ছেড়ে তিনি তিনি ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখ অনন্তলোকে যাত্রা করেছেন। তার শূন্যতা অপূরণীয়। হাজার দর্শক, শ্রোতা, ভক্তদের কাঁদিয়ে এই চলে যাওয়া ক্ষতির। তার নামের অগ্রভাগে অনায়াসে যুক্ত হয়েছিল লালন সম্রাজ্ঞীর অভিধা। লালনগীতির অসামান্য ভাবনা হৃদয়ে ধারণ করে তিনি সংগীত পরিবেশন করেছেন।
ফরিদা পারভীনের জন্ম ৩১ ডিসেম্বর ১৯৫৪, নাটোরের সিংড়া উপজেলার শাওল গ্রামে। পিতা দেলোয়ার হোসেন চিকিৎসক ও মা রৌফা কোম গৃহিণী ছিলেন। পিতার বদলি সূত্রে তিনি লেখাপড়া করেছেন মাগুরা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়ার মীর মশাররফ বালিকা বিদ্যালয় ও মেহেরপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে তার প্রাথমিক পাঠ সম্পন্ন হয়। কুষ্টিয়ার মীর মশাররফ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯৭২ সালে এসএসসি ও কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে ১৯৭৪ সালে এইচএসসি উত্তীর্ণ হয়ে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে বাংলা বিভাগে তিনি স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। মাগুরা থাকাকালে তার গানের শিল্পগুরু ছিলেন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তী। পরে কুষ্টিয়ায় রবীন্দ্র বায়, মোতালেব বিশ্বাস ও ওসমান গনির কাছে ধ্রুপদী সংগীতের শিক্ষা ও দীক্ষা গ্রহণ করেন। তানপুরা বাদনে তার চর্চা ছিল ঈর্ষণীয়। পরে আবদুল কাদেরের কাছে নজরুলসংগীতের খুঁটিনাটি জানেন। নজরুলসংগীতের স্বরলিপির সহজ আয়ত্ত তিনি এ সময় সম্পূর্ণ করেন। মোজাফফর আলী ফরিদা পারভীনকে মেহেরপুরে স্বরলিপির পাঠ প্রদান করেন। ফরিদা পারভীন ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বেতারে নজরুলসংগীতশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি কুষ্টিয়ায় লালন আশ্রমে গমন করে লালনগীতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ হন। তিনি লালনগীতির শিল্পী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ‘সত্য বল সুপথে চল’ লালনের এই গীতি পরিবেশন তাকে খ্যাতির মধ্যগগনে পৌঁছে দেয়। আবু জাফর রচিত আধুনিক ও দেশাত্মবোধক সংগীত পরিবেশনা তাকে দিয়েছে বিশেষ পরিচিতি।
এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা, সুরমা তটে, তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকা দির নাম’ ‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে, ‘প্রেমের কি শখ আছে বলো’, খাঁচার ভিতর আরশি নগর সংগীত তাকে অমরত্ব দিয়েছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
ফরিদা পারভীন লোকসংগীতের একজন ধ্রুবতারা। বাংলার মৃত্তিকা, বাংলার সংগীত পরিবেশন তার জীবনকে করেছে সমৃদ্ধ। তিনি মানুষকে সঞ্জীবনী জাদুমন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন। তার জীবনাচরণ ও সংগীত সাধনা তার স্থান তাকে চিরন্তন করে রেখেছে। তার বোন ফাহমিদা খাতুন যিনি নজরুলসংগীতশিল্পী হিসেবে পরিচিত, তার অনুপ্রেরণায় তিনি সংগীত সাধনা শুরু করেন। রাজশাহী বেতারে ফরিদা পারভীনের বহু গীত সংগীত জনপ্রিয়তার শীর্ষে তাকে নিয়ে যায়। তিনি জীবনের বাঁকে বাঁকে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে লালনের আধ্যাত্ম দর্শন প্রচারে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। তার গায়কীর বিশেষ ধরন লক্ষ করা যায়। তিনি খ্যাতিমান শিল্পীর মর্যাদায় অভিষিক্ত হন। লালনের সেইগীতি- সময় গেলে সাধন হবে না, খাঁচার ভিতর অচিন পাখী, মিলন হবে কতদিনে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে তার পরিচিতি আনে। তাকে নিয়ে যায় শীর্ষে। তিনি জীবনের বাঁকে বাঁকে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছেন। তার বিখ্যাত সংগীত হলো- ‘বহুদিন হলো ঘর ভেঙেছি।’
ফরিদা পারভীন প্রথম জীবনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন অধ্যাপক আবু জাফর ও পরবর্তী পর্যায়ে বংশীবাদক আবদুল হাকিমের সঙ্গে। ফরিদা পারভীন দীর্ঘদিন ধরে কিডনিসংক্রান্ত জটিলতা ও অন্যান্য অসুখে ভুগছিলেন। ১৩ সেপ্টেম্বর ফরিদা পারভীন মৃত্যুবরণ করেন। ফরিদা পারভীনের তিরোধানে সংগীত ভুবনে এক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। অনেক কিংবদন্তি শিল্পী আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাদের স্থান পূরণ হয়নি। ফরিদা পারভীনের মতো শিল্পীরা যুগে যুগে একজন হয়েই জন্মগ্রহণ করেন। তার সংগীত পরিবেশনা ইতিহাসের এক মাইলফলক হিসেবেই বিবেচিত। তিনি যখন সংগীত পরিবেশন করতেন তখন পিনপতন নীরবতার পরিবেশ হতো। দর্শক গভীর পর্যবেক্ষণ ও আনন্দচিত্তে তার সংগীতে একাকার হতেন। কিংবদন্তিতুল্য এই শিল্পীর চলে যাওয়ায় এক শোকস্তব্ধ পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এক বিধুর, হাহাকারময় পরিবেশ তৈরি করে চলে গেলেন নীরবে, নিভৃতে। এই চলে যাওয়া একজন পূর্ণাঙ্গ শিল্পীর জীবন অবসান শুধু নয়, একটি ইতিহাস থেকে একটি নক্ষত্রের পতন ধ্বনি প্রতিধ্বনির প্রতিভাস মাত্র।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
বিদায় ফরিদা পারভীন! আপনি আমাদের হৃদয়ের গভীরে চিরজাগরূক হয়ে থাকবেন।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
সাইফুজ্জামান : প্রাবন্ধিক