বীমা গ্রাহকের সুরক্ষা
বীমা গ্রাহকদের সুরক্ষা নিশ্চিতে যাদের ভূমিকা মুখ্য তারা হলেন বীমা পলিসির আবেদন, বিক্রয় বা প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি, বীমা এজেন্ট বা ব্রোকার অথবা এজেন্ট নিয়োগকারী বা জরিপকারী বা বীমা গ্রাহক, বীমাকারী প্রতিষ্ঠান অথবা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিয়োগকৃত কোনো পরিষেবা প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান।
‘বীমাকারীর করপোরেট গভর্ন্যান্স গাইডলাইন, ২০২৩’ অনুযায়ী বীমা দাবিসংক্রান্ত অভিযোগ যথাসময়ে নিষ্পত্তি ও গ্রাহকের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত প্রক্রিয়া ও কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিতের লক্ষ্যে পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক গঠিত গ্রাহক সুরক্ষা ও অভিযোগ প্রতিকার কমিটির সদস্যদের এমন ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে গ্রাহকের সুরক্ষা নিশ্চিত ও দ্রুত প্রতিকার সম্ভব হয়। এ ছাড়া বীমা আইনসহ বাংলাদেশের প্রচলিত অন্যান্য আইনে উল্লেখিত গ্রাহকের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে ওই কমিটিকে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। তদুপরি গ্রাহকের অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে গ্রাহক সুরক্ষা ও অভিযোগ প্রতিকার কমিটিকে কিছু অপরিহার্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
গ্রাহক সুরক্ষা ও অভিযোগ প্রতিকার কমিটির আওতায় অভিযোগ নিষ্পত্তির কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে অভিযোগ নিষ্পত্তি বা সমাধান করার পথ সুগম করতে হবে। বীমাকারীর প্রধান কার্যালয়ে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থাসহ অভিযোগ গ্রহণ, নথিভুক্তি এবং নিষ্পত্তির কার্যকর ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। সব বীমাকারীকে তার নিজ নিজ অভিযোগ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া এবং এ সংক্রান্ত গৃহীত কার্যক্রম বীমা গ্রাহকসহ জনসাধারণের অবগতির জন্য পঠনযোগ্য মুদ্রিত বুকলেট বা গ্রহণযোগ্য মাধ্যমে প্রচার করতে হবে এবং ওয়েবসাইটে তা বিশেষভাবে প্রদর্শিত হতে হবে। বীমা গ্রাহকসহ সংশ্লিষ্ট সবার অভিযোগসংক্রান্ত ফোনকল, ই-মেইল বা অন্য কোনো পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে তা আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ ও নিষ্পন্ন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। যে কোনো অভিযোগ বিলম্বিত না করে সর্বোচ্চ ত্রিশ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে।
বীমাকারী কর্তৃক বীমাসংক্রান্ত কোনো অভিযোগের নিষ্পত্তি বা অবসান হয়েছে তখনই প্রতীয়মান হবে, যখন বীমাকারী অভিযোগকারীর সব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে অথবা অভিযোগকারীকে লিখিত উত্তর প্রেরণের পর আট সপ্তাহের মধ্যে বীমাকারী ওই অভিযোগকারীর কাছ থেকে কোনো প্রত্যুত্তর প্রাপ্ত হয়নি। যদি বীমাকারী কোনো বীমা গ্রাহকের অভিযোগ নিষ্পত্তিতে ব্যর্থ হয়, সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বীমা গ্রাহক অভিযোগটি নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আইন মোতাবেক কর্তৃপক্ষ বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটির কাছে আবেদন বা অভিযোগ করতে পারবে। একজন গ্রাহককে বীমা দাবি বিষয়ে আইনের বিধানমতে কর্তৃপক্ষ বা বিরোধ নিষ্পত্তি কমিটির কাছে আবেদন করা থেকে বিরত রাখা যাবে না।
একজন বীমাকারী অথবা এজেন্ট বা ব্রোকার বা এজেন্ট নিয়োগকারী বা জরিপকারী কর্তৃক গ্রাহকের সব তথ্য সংরক্ষণে উপযুক্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তবে আদালতের আদেশ বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের আইনানুগ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করতে পারবে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বীমা গ্রাহক কর্তৃক বীমা চুক্তিতে বর্ণিত কোনো বিষয়ের ব্যত্যয় ঘটালে বীমা গ্রাহক ওই ব্যত্যয় ছাড়া বাকি অংশের ক্ষেত্রে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী হবেন। তবে ছোট করণিক ভুলের কারণে চুক্তির মৌলিক শর্তাদিতে কোনোরূপ বাস্তব পরিবর্তন না হলে, সে ক্ষেত্রে বীমা গ্রাহক এ সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী হবেন। বীমা চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর কোনো তথ্য পরিবর্তন বা তথ্য প্রকাশ করা প্রয়োজন বা বাধ্যবাধকতা থাকলে বীমা গ্রহীতা কর্তৃক আবশ্যিকভাবে বীমাকারীকে তা লিখিতভাবে অবহিত করতে হবে। বীমা গ্রাহককে বীমা পরিকল্প বা পলিসিসংক্রান্ত রসিদসহ অন্য আনুষঙ্গিক দলিলাদি আবশ্যিকভাবে বুঝে নিতে হবে এবং তা সংরক্ষণ করতে হবে।
বীমা পরিকল্প বা পলিসি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে এবং বিক্রির ক্ষেত্রে অনুমোদিত পরিকল্প বা পলিসির কোনোরূপ ব্যত্যয় করা যাবে না এবং প্রাপ্য পরিকল্প বা পলিসির প্রকৃত সুবিধা ও শর্তাদি সুস্পষ্টভাবে গ্রাহককে বোধগম্য ও সহজ ভাষায় অবহিত করতে হবে। বীমা পরিকল্প বা পলিসি অন্য কোনো নাম বা অন্য কোনো পণ্য হিসেবে বিক্রি করা যাবে না, অনুমোদিত বীমা পরিকল্প বা পলিসি হিসেবেই বিক্রি করতে হবে। বীমা পরিকল্প বা পলিসির দলিলে বীমাকারীর নাম ও রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট নম্বর, বীমাকারীর যোগাযোগের বিবরণ এবং প্রকৃত ঠিকানা, পলিসির নাম, শ্রেণি এবং প্রয়োজনীয় বর্ণনা এবং কর্তৃপক্ষের নাম ও ঠিকানা থাকতে হবে। গ্রাহককে এরূপ কোনো ধারণা বা আশ্বাস মৌখিক বা লিখিত বা অন্য কোনোভাবে প্রদান করা যাবে না যা বীমা পরিকল্পে নেই।
গ্রাহকের প্রয়োজন বা চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উপযুক্ত বীমা পরিকল্প বা পলিসি গ্রাহকের কাছে উপস্থাপন করতে হবে এবং গ্রাহকের কাছে কোনো বীমা পরিকল্প বা পলিসি প্রভাবিত বা প্ররোচিত করে বিক্রি করা যাবে না। কোনো অবস্থায় মিথ্যা বা জাল তথ্যাদি বা দলিলাদি উপস্থাপন করা যাবে না এবং বীমা গ্রাহকের লিখিত সম্মতি ব্যতিরেকে বীমা চুক্তিতে কোনোরূপ পরিবর্তন করা যাবে না। পলিসির মেয়াদপূর্তি বা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ বা জরিমানা অথবা কোনো বিনিয়োগ বা বীমা পলিসির সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য ঝুঁকি থাকলে তা বীমা গ্রাহককে বীমা পরিকল্প বিক্রয়ের আগে অবহিত করতে হবে। বীমাকারী এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ উভয়ের কাছে বীমা দাবিসহ বীমাসংক্রান্ত অভিযোগ দায়ের করার পদ্ধতি বিস্তারিত উল্লেখ করতে হবে। কোনো বীমা পরিকল্প বা পলিসি বিনিয়োগের ভিত্তিতে রিটার্ন প্রাপ্তি থাকলে, রিটার্ন প্রাপ্তির কোনোরূপ নিশ্চয়তা প্রদান করা যাবে না।
বীমাকারী বা এজেন্ট বা ব্রোকার বা জরিপকারী বা এজেন্ট নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বদা সততা, ন্যায্যতা, যথাযথ দক্ষতা, পেশাদারত্ব, যত্ন এবং পরিশ্রমের সঙ্গে পরিষেবা প্রদান করবে। সম্ভাব্য গ্রাহককে পরিষ্কার, সুস্পষ্ট, পঠনযোগ্য, মুদ্রিত বুকলেট, বীমা পরিকল্প বিপণন প্রস্তাবনাপত্র ও প্রসপেক্টাস প্রদান করবে, যেখানে প্রস্তাবিত বীমার আওতাভুক্ত সুবিধা বা কাভারেজের পরিমাণ, সীমাবদ্ধতা, অস¦ীকৃতি ও ব্যাখ্যাসহ সব প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সঠিক ও স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত বা বিদ্যমান পলিসি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে প্রয়োজনীয় সব তথ্য প্রদান করবে। বীমাকারী বীমা গ্রাহকের সব তথ্যের ডাটাবেজ তৈরি ও সংরক্ষণ করবে এবং পরে সংশ্লিষ্ট গ্রাহক কোনো তথ্য লিখিতভাবে চাইলে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
বীমা গ্রহীতার সঙ্গে সহজবোধ্য ভাষা ব্যবহারের পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে যোগাযোগ ও লেনদেন করতে হবে এবং বিপণন পলিসি-চুক্তি এবং প্রশংসাপত্র, ফরম, বিবৃতিসহ একজন গ্রাহককে বীমাকারী কর্তৃক প্রদত্ত লিখিত তথ্য বাংলা অথবা বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় হতে হবে। পলিসি বাবদ গৃহীত ও প্রদেয় আর্থিক সুবিধা, যে কোনো ফি ও চার্জ বা সুনির্দিষ্ট শর্ত বা আরোপ অথবা নির্দিষ্ট আর্থিক শর্তাবলি সুস্পষ্ট ও সঠিকভাবে বর্ণনা করতে হবে। বীমা চুক্তি অনুযায়ী বীমা গ্রহীতার পরিপালনীয় বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অবহিত করতে হবে। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বীমা পরিকল্প বিক্রির পনেরো দিনের মধ্যে ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল পদ্ধতিতে ওই বিক্রীত পলিসির মানিরিসিপ্ট বীমাকারী কর্তৃক ইস্যু ও সংরক্ষণ করতে হবে এবং ওই মানিরিসিপ্ট বীমা গ্রাহককে প্রেরণ নিশ্চিত করতে হবে। তবে বীমাকারী ছাড়া অন্য কেউ ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল পদ্ধতিতে মানিরিসিপ্ট ইস্যু করতে পারবে না।
বীমাকারী কর্তৃক বীমা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বুকলেট, ফ্লায়ার প্রভৃতি সরবরাহ ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশ করতে হবে। বীমাকারীকে বীমাশিল্প বিকাশে দেশের সর্বত্র প্রচারণার লক্ষ্যে সেমিনার, কনফারেন্স, ওয়ার্কশপ প্রভৃতির আয়োজন করতে হবে। সব প্রস্তাবিত পরিকল্প অথবা পলিসির হালনাগাদ তালিকা নিজ নিজ ওয়েবসাইটে প্রদর্শন নিশ্চিত করতে হবে এবং তা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বীমা গ্রাহকদের স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জারিকৃত গাইডলাইন অনুযায়ী দেশে বীমাশিল্পের প্রসার এবং প্রচারণার লক্ষ্যে বর্ণিত বিষয়বস্তুগুলো সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
সরফরাজ হোসেন এফসিএস : কোম্পানি সচিব, পিপল্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড