ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের প্রভাব

মুশতাক হোসেন
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের প্রভাব

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন দুটি স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রাণবন্ত ছিল। নির্বাচনে সবাই অংশগ্রহণ করেছেন। রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের বাইরেও প্রচুর স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশগ্রহণ করেছেন। আগে মনে করা হতো ছাত্রসংসদ নির্বাচন শুধু প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের বিষয়; কিন্তু বর্তমানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা, যারা ছাত্রসংগঠন করেন না তারাও নিজেদের নির্বাচনের অংশীদার মনে করছেন। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর এই পরিবর্তনটা এসেছে। এর আগে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিল; কিন্তু এত ছিল না। দলের বাইরে স্বতন্ত্র ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের পাশাপাশি মেইনস্ট্রিমে উপস্থিতি সেটা আগে ছিল না। এবার এটা নতুন বৈশিষ্ট্য।

তবে অতীতের মতো এবারও নির্বাচন পরিচালনা সম্পর্কে এবং অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ এসেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তো কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে তাদের ভুলত্রুটি হয়েছে। নির্বাচন পরিচালনায় তাদের অভিজ্ঞতা ছিল না। ৩৩ বছর জাকসু নির্বাচন হয়নি। যারা শিক্ষক আছেন তাদের অনেকের ছাত্রজীবনেও নির্বাচনের অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে ডাকসুর কিছুটা ছিল। তা-ও কয়েক বছর আগে। সেই অভিজ্ঞতাটা ভালো ছিল না। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এই যে অবিশ্বাস-অনাস্থা এটি অতীতেও ছিল, এখনও হচ্ছে। কারণ শিক্ষকদের একাংশের সরকারি দলের আনুকূল্যে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা নেওয়া, এ জন্য ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার করা- এগুলো তো ছাত্রছাত্রীরা দেখেছেন। তাই একটা অনাস্থা তো আছেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব স্বচ্ছতার সঙ্গেই নির্বাচন হয়েছে। তারপর ভোট গণনা হয়েছে। সিসি ক্যামেরায় দেখেছি আমরা, তার পরও কিন্তু অবিশ্বাসের প্রশ্ন এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আবার যন্ত্রের ব্যবহারের প্রতি অনাস্থা। তাদের যন্ত্র ঠিকমতো কাজ করছিল না। যে ওএমআর মেশিন, সেটি রিড করতে পারছিল না। আমরা দেখছি এখন পুরনো ফুটেজ, যে ওএমআর মেশিন ঠিকভাবে রিড করছে না, সেই মেশিনের কী প্রয়োজন? তারপর হাতে গোনা, সেটাতে একজন বলেন আরেকজন লেখেন। তাহলে এখানেও কিন্তু ভুল হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তার পরও অভ্যস্ততার কারণে ভোটাররা হাতে গোনা ব্যালটকে তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য মনে করছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা চাচ্ছেন যে, ব্যালট হাতে গোনা হোক। তো এগুলো টেকনিক্যাল জিনিস, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আস্থা, পারস্পরিক আস্থা।

জাতীয় নির্বাচনে তো অবিশ্বাসের অনেক কারণ রয়েই গেছে। নির্বাচন কমিশনে উচ্চ পর্যায়ের বদল হয়েছে; কিন্তু যারা কর্মচারী-কর্মকর্তা তারা পুরনো মনোভাব নিয়েই আছেন। দীর্ঘদিন ধরে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না বাংলাদেশে। ২০০৮ সালের পর থেকে সাজানো নির্বাচন, সেই একটা অবিশ্বাস কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে থাকবে। এখন থেকেই এটি সমাধানের উপায়গুলো বের করা দরকার।

ছাত্রদের মনোভাব ছিল প্রচলিত রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে। বিশেষ করে যারা দখলবাজি করেছে, ছাত্রদের ওপর অত্যাচার করেছে। রাজনৈতিক সংগঠনকে ব্যবহার করে এগুলো করেছে। বিগত সরকার মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলার নামে চরম অত্যাচারী শাসন চালিয়েছে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু সেøাগান তুলে ছাত্রছাত্রীদের লাঠিপেটা করেছে, গেস্টরুমে কান ধরে উঠবোস করিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পাঠ করার নামে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গেস্টরুমে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, ক্লাসের অ্যাসাইনমেন্ট করতে দেয়নি। রাতে ঘুমাতে না দিয়ে ছিনতাইকারী দলীয় কর্মীদের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে পাঠিয়েছে। ছেলেমেয়েদের জোর করে দলীয় কর্মসূচিতে নিয়ে গেছে। তাদের মাথা নুইয়ে কুঁজো হয়ে হাত পেছনে নিয়ে বা হাত কচলিয়ে নেতাকে সালাম করতে বাধ্য করেছে। সেই নেতা হয়তো পড়াশোনা করেন না, চাঁদাবাজি ও ছিনতাই করে বেড়ান। এসব অপমান ও গ্লানির বিরুদ্ধে একটা তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সেটার ফসল কেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের গোলায় উঠল না? কারণ, অতীতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল একই কাজ করেছে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পরে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নামধারী কর্মীরা সারাদেশে মব সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মানুষকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়, ভুয়া খুনের মামলা দিয়ে টাকা খেয়ে সে মামলা তুলে নেওয়া- এসব অপকর্ম করেছেন। তাদের ভালো হয়ে যাওয়ার শপথ নেওয়াটা ছাত্রছাত্রীরা তামাশা হিসেবেই নিয়েছেন।

অন্যদিকে স্বতন্ত্র এবং যারা আদর্শভিত্তিক সংগঠন, যারা অতীতে দখলবাজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে অত্যাচারিত হয়েছে, তারা বিভিন্ন প্যানেলে বিভক্ত হওয়ায় ছাত্রছাত্রীরা তাদের ওপর ভরসা করতে পারেননি। আদর্শভিত্তিক প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো অতীতে ডাকসু ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদগুলোতে জয়লাভ করেছে। কিন্তু সে ধারাবাহিকতা তারা ধরে রাখতে পারেনি। তাদের সহযোগী প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোও ছাত্রসংগঠনকে স্বাধীনভাবে বিকশিত হতে দেয়নি। রাজনৈতিক দলের কর্মী রিক্রুট কেন্দ্র হিসেবেই তারা ছাত্রসংগঠনকে দেখেছে। অত্যাচারের বিরুদ্ধে সিরিয়াস কোনো ছাত্র-আন্দোলন গড়ার পথ থেকে তাদের ছাত্রসংগঠনকে তারা নিরাপদে সরিয়ে রেখেছে। আন্দোলন যতটুকু করলে প্রচার পাবে ততটুকুই করতে অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় ছাত্রসংগঠনগুলো প্রকাশ্যে মাদ্রাসায় এবং গোপনে বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী ছাত্রলীগকে প্রতিরোধ করার কাজকে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ থেকেই করেছে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানেও তার প্রমাণ তারা রেখেছে। তাই প্রগতিশীলরা আগের অন্য আন্দোলনগুলোর মতো আপসহীন শক্তি হিসেবে ছাপ রাখতে পারেনি।

এই পটভূমিতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তাই মন্দের ভালো ভেবে শিবির সমর্থিত প্রার্থীদের জয়ী করেছেন। তবে তারাও একটি রাজনৈতিক দলের শাখা হিসেবে কাজ করেছে, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা দখলদারত্ব করেছে, সন্ত্রাস-নির্যাতন চালিয়েছে। ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়তো তারা সে রকম হল দখল করতে পারেনি।

গণ-অভ্যুত্থানের পর যারা নির্বাচন করেছে তারা সবাই চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের অংশীদার। কিন্তু দেখা গেল যে, রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন, যেটা বড় ধরনের, ক্যাম্পাসের মধ্যে তারা হয়তো দখলদারত্ব করেনি বা করতে পারেনি, কিন্তু ক্যাম্পাসের বাইরে সেই ছাত্রসংগঠন নানা ধরনের অপকর্মে, মব সন্ত্রাসে জড়িত। ক্যাম্পাসের ভেতরে তারা করতে পারেনি, তারা এখানে সংযত হয়ে চলেছে। ক্যাম্পাসের বাইরে তো তারা সেই কাজটা করেছে, ফলে তারা বৃহত্তম ছাত্রসংগঠন হওয়ার পরও সুবিধা করতে পারেনি। যে রাজনৈতিক দল ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে দল-ঘনিষ্ঠরা ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ভালো করার কথা ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে আদর্শের অনুপস্থিতি, সহযোগী রাজনৈতিক দলের নানা কেলেঙ্কারি ও পুরনো রাজনৈতিক ধারায় তহবিল সংগ্রহে অস্বচ্ছতা-দুর্নীতি, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অরাজনৈতিক কৌশল প্রভৃতির কারণে তাদেরও ভরাডুবি হয়েছে। এসব প্যানেলের মধ্যে দেখা গেল ইসলামী ছাত্রশিবির ও ছাত্রী সংস্থা সবচেয়ে সংগঠিত ছাত্রসংগঠন। ভোটের মাঠে এই ছাত্রসংগঠন ধর্মীয় আদর্শ নিয়ে সামনে আসেনি। তারা ভিন্নভাবে নিজেদের উপস্থিত করেছে। যদিও সবাই জানত যে, এটা ধর্মভিত্তিক ছাত্রসংগঠন। ভোটের মাঠে নারীদের তারা ঘরবন্দি করে রাখতে চায় সে ধরনের কথা বলেনি, মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার চেতনার বিরুদ্ধে তাদের কোনো কথা ছিল না। তো সেটা যদি তারা বজায় রাখে তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে বড় সমস্যা হবে না। আর যদি এখন এই জয়ের পর তারা মনে করে যে, এখন তারা মুক্তিযুদ্ধ ও তার নেতাদের মর্যাদার বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যেতে পারবে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে- তাহলে তারা খুব দ্রুত এই ছাত্রসমাজের প্রতিরোধের মুখে পড়বে।


ড. মুশতাক হোসেন : স্থায়ী কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ জাসদ, সাবেক জিএস, ডাকসু ১৯৮৯-৯০


মতামত লেখকের নিজস্ব