মার্কিন রাজনীতিতেও সহিংসতার নতুন আতঙ্ক
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাজনৈতিক সহিংসতার চিত্র অপরিচিত নয়। জনসভায় বা সমাবেশে রাজনৈতিক নেতাদের অতর্কিত হত্যা, হামলা, বা হুমকি প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু সম্প্রতি এই প্রবণতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে আমেরিকা, ইউরোপ ও জাপানের মতো উন্নত রাষ্ট্রগুলোতেও। যারা একসময় গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে, রাজনৈতিক অঙ্গন এখন সহিংসতা ও আতঙ্কের নতুন শিকার। প্রতিশ্রুতিশীল তরুণরা কি আর রাজনীতিতে নাম লেখাতে চাইবেন, এমন প্রশ্ন এখন তীব্রভাবে উঠছে। কারণ, রাজনৈতিক সহিংসতা ও আতঙ্কের কারণে রাজনীতি চর্চা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তরুণ রক্ষণশীলদের দূত চার্লি কার্কের মতো উদীয়মান তারকার হত্যাকাণ্ড এই আতঙ্কের এক চরম দৃষ্টান্ত। এই হত্যাকাণ্ড গত এক বছরে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক সহিংসতার এক ভয়াবহ পরিণতি। রাজনৈতিক নেতারা এখন জনসাধারণের সামনে খোলা জায়গায় প্রচার চালানোর বিষয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন। এই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি নৃশংস ঘটনা নয়, বরং এটি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত এক নতুন উদ্বেগের প্রতিফলন।
চার্লি কার্কের হত্যাকাণ্ড একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধির এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক মেরুকরণ তীব্র হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সংবাদ মাধ্যমে ক্রমাগত ঘৃণা ও বিভেদের বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে। যা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শত্রু হিসেবে দেখানোর প্রবণতাকে বাড়িয়েছে। এই ধরনের উসকানিমূলক পরিবেশ শেষ পর্যন্ত শারীরিক সহিংসতার রূপ নিচ্ছে।
অতীতেও যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যেমন জন এফ কেনেডি বা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের হত্যাকাণ্ড। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখন সহিংসতা শুধু উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের লক্ষ্য করে ঘটছে না, বরং এটি সমাজের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতা, এমনকি সাধারণ ভোটাররাও এখন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। এই ধরনের সহিংসতা একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য মারাত্মক হুমকি। যখন রাজনৈতিক মতপার্থক্য শারীরিক আক্রমণের দিকে মোড় নেয়, তখন মুক্ত ও স্বাধীন আলোচনা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
চার্লি কার্কের হত্যাকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রেরসহ সারা বিশ্নের প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ প্রজন্মের কাছে একটি কড়া বার্তা দিয়েছে। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলার মতো একটি পেশা। কার্ক ছিলেন একজন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ। যিনি তার আদর্শ ও বিশ্বাস নিয়ে কাজ করছিলেন। তার অকাল মৃত্যু অনেক তরুণকে রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে দিতে পারে। তারা ভাবতে পারে, কেন তারা এমন একটি বিপজ্জনক পেশা বেছে নেবেন? যেখানে তাদের জীবন হুমকির মুখে থাকবে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
এই পরিস্থিতিতে, রাজনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণ কমে গেলে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে। একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তরুণ প্রজন্মের ওপর। যদি তারা রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বয়স্ক এবং একই চিন্তাধারার মানুষের হাতে থেকে যাবে। এর ফলে নতুন ধারণা, নতুন উদ্যম এবং সমাজের পরিবর্তনশীল চাহিদা অনুযায়ী নীতি প্রণয়নের সুযোগ সীমিত হবে। তরুণদের অংশগ্রহণ ছাড়া গণতন্ত্র প্রাণবন্ত হতে পারে না।
রাজনৈতিক সহিংসতার এই বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক গভীর অবনমনের প্রতিফলন। রাজনৈতিক বিতর্ক এখন আর নীতি বা আদর্শ নিয়ে নয়, বরং ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শয়তানের প্রতিমূর্তি হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যখন একজন রাজনৈতিক নেতাকে খোলাখুলিভাবে ‘শত্রু’ বা ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তখন তার উপর হামলা চালানোর বৈধতা তৈরি হয়।
এই বিদ্বেষপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়েছে বিভিন্ন কারণে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যালগরিদমও এমনভাবেই ডিজাইন করা হয়েছে। যেখানে এটি ব্যবহারকারীদের তাদের নিজস্ব ধারণার মধ্যে আটকে রাখে। ভিন্ন মতের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেয়। এর ফলে, সমাজের বিভাজন আরও তীব্র হয়। রাজনৈতিক নেতারাও প্রায়শই এই ধরনের বিদ্বেষপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করেন। যা তাদের অনুসারীদের মধ্যে সহিংস প্রবণতাকে উৎসাহিত করে।
দেশে দেশে রাজনীতিতে এই সহিংসতা বন্ধ করতে হলে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, রাজনৈতিক নেতাদের নিজেদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের বিদ্বেষপূর্ণ ভাষা ব্যবহার বন্ধ করতে। রাজনৈতিক বিতর্কে আরও শালীনতা বজায় রাখতে হবে। তাদের অনুসারীদের মধ্যে ঘৃণা বা সহিংসতা উসকে দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত নিজেদের কর্মীদের সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করা। পাশাপাশি সহিংস আচরণকে নিন্দা জানানো।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক নেতাদের এবং তাদের সমর্থকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। জনসভা বা সমাবেশে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। বিশেষ করে, তরুণ এবং উদীয়মান নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত। কারণ তারা প্রায়শই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকেন।
তৃতীয়ত, সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। তারা যেন এমন সংবাদ বা বিষয়বস্তু প্রকাশ না করে যা সমাজে বিভেদ বা ঘৃণা ছড়ায়। সমাজের সকল স্তরের মানুষকে এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
সর্বোপরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গণতন্ত্র, সহনশীলতা এবং রাজনৈতিক বিতর্কের গুরুত্ব সম্পর্কে শেখানো উচিত। তরুণ প্রজন্মকে শেখাতে হবে যে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও কীভাবে সম্মানজনকভাবে একে অপরের সাথে আলোচনা করতে হয়।
গত এক দশকে আমেরিকায় রাজনীতিবিদদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা বলা কঠিন। তবে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা এবং সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সাল থেকে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০১৭ সালের কংগ্রেসনাল বেসবল অনুশীলন হামলা;২০২২ সালের ন্যান্সি পেলোসির স্বামীর ওপর হামলা;২০২০ সালের মিশিগান গভর্নর গ্রেচেন হুইটমারকে অপহরণের চেষ্টা;২০২৪ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর একাধিক হামলার চেষ্টা; ২০২৫ সালে মিনেসোটার এক রাজ্য আইনপ্রণেতাকে হত্যা; ২০২৫ সালে চার্লি কার্কের হত্যাকাণ্ড।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
চার্লি কার্কের হত্যাকাণ্ড শুধু একটি দুঃখজনক ঘটনা নয়, বরং এটি মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য এক গভীর সতর্কবার্তা। রাজনৈতিক সহিংসতা এখন আর শুধু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সমস্যা নয়, এটি উন্নত দেশগুলোরও মাথাব্যথার কারণ। এই প্রবণতা বন্ধ না হলে, যুক্তরাষ্ট্র তার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং আদর্শ থেকে দূরে সরে যাবে। রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ কমে গেলে, তার পরিণতি হবে মারাত্মক। একটি সুস্থ ও প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সহনশীলতা। কোনোভাবেই সহিংসতা নয়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সমাজ এবং প্রত্যেক নাগরিককে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক