ইউকের এনএইচএস মডেল কি বাংলাদেশের জন্য সম্ভব?
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে অভিযোগ নতুন নয়। রোগে পড়লেই নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো অর্থনৈতিকভাবে দিশাহারা হয়ে পড়ে। ইউনিয়ন পর্যায়ে ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা পেতেও ভোগান্তি, অথচ ধনী-উচ্চবিত্তরা সামান্য জটিল চিকিৎসার জন্যই বিমানে উঠে বসেন—গন্তব্য থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর কিংবা ভারত। প্রতিবছর এই বিদেশমুখী চিকিৎসা খাতে গুনতে হচ্ছে ৩.৫–৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশ কি চাইলেই ইউকের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস)–এর মতো একটি সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা মডেল গড়ে তুলতে পারবে?
এনএইচএস স্বাস্থ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার এক ঐতিহাসিক মডেল : ১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্যে চালু হওয়া এনএইচএস আজও বিশ্বের সবচেয়ে বড় সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। এর মূল শক্তি হলো কর-ভিত্তিক অর্থায়ন। নাগরিকদের কাছ থেকে সংগৃহীত আয়কর ও জাতীয় বীমা (National Insurance) ফান্ড থেকেই পুরো সিস্টেম চালিত হয়।
এনএইচএস’র দর্শন ছিল সহজ। ‘চিকিৎসা হবে সকলের জন্য সমান, আর তা হবে নাগরিকের মৌলিক অধিকার।’ এই কারণে ব্রিটিশ নাগরিকরা প্রাথমিক চিকিৎসা থেকে শুরু করে জীবনরক্ষাকারী সার্জারি—অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিনামূল্যে পান। এনএইচএস প্রাইমারি কেয়ার–কে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। প্রথম ধাপে রোগী যায় পরিবারিক চিকিৎসক (GP) বা স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, তারপর প্রয়োজন অনুযায়ী বিশেষায়িত হাসপাতালে রেফার করা হয়।
তবে এনএইচএস-ও নিখুঁত নয়। বর্তমানে ব্রিটেনে বাজেট ঘাটতি, ডাক্তার-নার্স সংকট ও দীর্ঘ অপেক্ষার তালিকার কারণে সিস্টেম চাপের মুখে পড়ে। তবু স্বীকার করতেই হয়—সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা যদি জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তবে এনএইচএস এখনো বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকর মডেল।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য চিত্র: বাস্তবতা ও সংকট: বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ১০ লাখ। স্বাস্থ্যসেবার প্রেক্ষাপটে কয়েকটি পরিসংখ্যান বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে তোলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO-) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যয় GDP-এর মাত্র ২.৩৬%।
সরকারি স্বাস্থ্যখরচ GDP-এর মধ্যে সীমিত—০.৭–১%। ([WHO & IndexMundi])
মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৭–৭০% জনগণকে পকেট থেকে দিতে হয়—যা এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ।
প্রতি ১,০০০ জনে চিকিৎসক সংখ্যা ০.৬৭; নার্সের অনুপাত তার চেয়েও কম।
প্রতিবছর বিদেশে চিকিৎসা খাতে খরচ হচ্ছে ৩.৫–৫ বিলিয়ন ডলার।
অর্থাৎ বাংলাদেশে সরকারি বিনিয়োগ অপ্রতুল, প্রাইভেট খরচ অত্যধিক, জনবল সংকট তীব্র, আর গ্রামীণ স্বাস্থ্য অবকাঠামো ভঙ্গুর। এর ফলে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো রোগ হলে সহজেই আর্থিক সঙ্কটে পড়ে যায়।
কেন মানুষ দেশ ছাড়ে? বাংলাদেশিদের বিদেশমুখী চিকিৎসা ব্যয়ের প্রধান কারণ আস্থার সংকট। থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতাল বছরে প্রায় ১২ লাখ বিদেশি রোগী নেয়, এর বড় অংশই দক্ষিণ এশিয়া থেকে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল বিশ্বখ্যাত কার্ডিয়াক ও নিউরোসার্জারির জন্য। ভারতের চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতাল তুলনামূলক সাশ্রয়ী খরচে জটিল সার্জারি ও লিভার ট্রান্সপ্লান্টের কারণে সুনাম অর্জন করেছে।
এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে—দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই এমন স্বাস্থ্যব্যবস্থা তৈরি হয়েছে যা স্থানীয় জনগণের পাশাপাশি বিদেশি রোগীদেরও আকর্ষণ করছে। বাংলাদেশও চাইলে একই ধাঁচে এগোতে পারে।
বাংলাদেশে এনএইচএস মডেল:
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
সুবিধা:
১. আর্থিক সুরক্ষা: আউট-অফ-পকেট ব্যয় কমে যাবে, ফলে দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকি কমবে।
২. সমতা: শহর-গ্রাম নির্বিশেষে সবার জন্য একই মানের স্বাস্থ্যসেবা।
৩. জনস্বাস্থ্য উন্নতি: ভ্যাকসিনেশন, মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের কর্মসূচি আরও কার্যকর হবে।
৪. আস্থা তৈরি: বিদেশমুখী চিকিৎসার প্রবণতা কমবে, বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় ঠেকবে।
প্রধান বাধা:
১. অর্থায়ন ঘাটতি: বর্তমান স্বাস্থ্য বাজেট যথেষ্ট নয়।
২. জনবল সংকট: পর্যাপ্ত ডাক্তার-নার্স তৈরি ও ধরে রাখা বড় চ্যালেঞ্জ।
৩. অবকাঠামো দুর্বলতা: ঢাকা-কেন্দ্রিক সেবা থেকে জেলা-উপজেলায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
৪. গভর্ন্যান্স সমস্যা: দুর্নীতি, মনিটরিং ও জবাবদিহিতার অভাব।
অর্থায়নের বাস্তব কৌশল: বাংলাদেশে এনএইচএস-ধাঁচের ব্যবস্থা চালু করতে হলে সাহসী অর্থনৈতিক সংস্কার প্রয়োজন।
১. স্বাস্থ্য বাজেট বৃদ্ধি: ধাপে ধাপে GDP-এর অন্তত ৪% পর্যন্ত উন্নীত করা।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
২. স্বাস্থ্যকর (Health Tax): তামাক, চিনি ও বিলাসপণ্যে বিশেষ কর ধার্য করে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়।
৩. সামাজিক স্বাস্থ্যবীমা: প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের জন্য বীমা চালু, দরিদ্রদের জন্য সরকারি ভর্তুকি।
৪. মিশ্র অর্থায়ন: সরকারি বাজেট + স্বল্প প্রিমিয়াম + আন্তর্জাতিক সহায়তা।
ধাপে ধাপে রোডম্যাপ :
ধাপ ১ (১–৩ বছর): ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র শক্তিশালী করা, দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে সেবা।
ধাপ ২ (৩–৬ বছর): রাজস্ব সংস্কার, নতুন কর বাস্তবায়ন, জেলা পর্যায়ে বিশেষায়িত হাসপাতাল।
ধাপ ৩ (৬–১২ বছর): সার্বজনীন কভারেজ—প্রাথমিক থেকে বিশেষায়িত হাসপাতাল পর্যন্ত একীভূত সেবা।
মানবসম্পদ ও প্রযুক্তি : আগামী ১০ বছরে ডাক্তার ও নার্সের সংখ্যা অন্তত দ্বিগুণ করতে হবে।
কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের ক্ষমতায়ন করে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় জোরদার করা দরকার।
ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা—ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ড, টেলিমেডিসিন, মোবাইল অ্যাপস—গ্রামীণ সেবা কাঠামোয় গেমচেঞ্জার হতে পারে।
আন্তর্জাতিক উদাহরণ :
থাইল্যান্ড: “৩০ বাত প্রোগ্রাম” দেখিয়েছে সীমিত বাজেটেও সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা সম্ভব।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
ব্রাজিল: কর-ভিত্তিক SUS সিস্টেম কোটি কোটি মানুষকে কভার করছে।
শ্রীলঙ্কা: সরকারি বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবার কারণে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হার দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম।
বাংলাদেশে বাস্তবায়নের জন্য পরামর্শ :
১. জাতীয় ঐকমত্য তৈরি—রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী ও জনগণের সম্পৃক্ততা।
২. স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বৃদ্ধি ও স্বচ্ছ অর্থায়ন কাঠামো।
৩. ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে বিস্তার।
৪. দুর্নীতি রোধে কঠোর মনিটরিং।
৫. আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল দেশে গড়ে তোলা।
বাংলাদেশে এনএইচএস-এর পুরো কাঠামো হুবহু কপি করা সম্ভব নয়। তবে এর মূল দর্শন—কর-ভিত্তিক সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, প্রাইমারি কেয়ার-কেন্দ্রিক সিস্টেম, আর্থিক সুরক্ষা ও সমতা—এসব গ্রহণ করে বাংলাদেশের বাস্তবতায় একটি হাইব্রিড মডেল দাঁড় করানো সম্ভব।
রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সাহসী অর্থায়ন সংস্কার আর মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে আগামী এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশ এমন একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে—যেখানে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই দেশের ভেতরেই আস্থার সঙ্গে চিকিৎসা নেবে।
কবীর আহমেদ ভূঁইয়া: চেয়ারম্যান, ভূঁইয়া গ্লোবাল ফাউন্ডেশন