জাতীয় পার্টি কি লেজুড়বৃত্তির দায় এড়াতে পারে

আশরাফুল ইসলাম
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
জাতীয় পার্টি কি লেজুড়বৃত্তির দায় এড়াতে পারে

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতীয় পার্টির ভূমিকা দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ। দলটির জন্ম হয়েছে সামরিক শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায়। এর প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে তার আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘন কিংবা দমননীতির কারণে স্বৈরশাসক অভিধায় অভিযুক্ত করা হয়। পরে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতন হয় এই স্বৈরশাহীর। সেই সময় জনগণই তার বিচার করে। তার তৈরি করা দলটি অবশ্য রাজনীতির অঙ্গনে টিকে যায়। তবে সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের লেজুড়বৃত্তিই ছিল দলটির মুখ্য ভূমিকা। সবকিছু ছাপিয়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার পেছনে দলটির প্রচ্ছন্ন সমর্থন ও ভূমিকা অনেকাংশে দায়ী। আন্তর্জাতিক আদালতে বর্তমানে শেখ হাসিনা সরকারের বিচার চলছে। তার নেপথ্য ভূমিকায় থাকা জাতীয় পার্টির নেতারা কি ছাড় পাবে? ইতিহাসের আলোকে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেওয়া যেতে পারে।

২০০৮ সালের পর থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তিনটি জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করেছে- ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে। প্রতিটি নির্বাচনই নানা অনিয়ম, কারচুপি ও প্রহসনের অভিযোগে বিতর্কিত হয়েছে। জনগণ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, বিরোধী দলগুলো কার্যত নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়েছে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি প্রতিবারই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং সরকারকে একটি কৃত্রিম প্রতিদ্বন্দ্বিতা উপহার দিয়েছে।

২০১৪ সালে যখন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। তখন জাতীয় পার্টি মাঠে থেকে হাসিনা সরকারের জন্য নির্বাচনী বৈধতা তৈরি করেছিল। ১৫২ আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। তার পরও সরকার গঠনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে জাতীয় পার্টি। একইভাবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে যখন সর্বত্র কারচুপির অভিযোগ উঠল, তখনও জাতীয় পার্টি অংশ নিয়ে সরকারের পক্ষে ভারসাম্য তৈরি করল। ২০২৪ সালেও একই ঘটনা ঘটল- প্রহসনের নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য জাতীয় পার্টি আবার হাসিনা সরকারের সহযোগী হয়ে উঠল।

এটি নিছক রাজনৈতিক কৌশল নয়। এটি ক্ষমতার অপব্যবহার ও জনগণের অধিকারহরণে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে এক নির্লজ্জ লেজুড়বৃত্তি। জাতীয় পার্টি এভাবে বিরোধী দলের মুখোশ পরে আসলে ক্ষমতাসীনদের অন্যায়কে আড়াল করেছে; তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখতে পাই, হিটলারের জার্মান বাহিনী ১৯৪০ সালে ফ্রান্স দখল করার পর মার্শাল ফিলিপ পেতাঁর নেতৃত্বে ফ্রান্সে ‘ভিশি সরকার’ গঠিত হয়। এই সরকার ছিল নাৎসি জার্মানির সহযোগী ও মিত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৪ সালে জার্মানি পরাজিত হলে ফ্রান্সে ভিশি সরকারের নেতাদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। একে ইতিহাসে বলা হয় Épuration légale (আইনি শুদ্ধি অভিযান)। ফ্রান্সের আদালত, সামরিক ট্রাইব্যুনাল ও বিশেষ ট্রাইব্যুনালগুলোয় লাখ লাখ মানুষকে তদন্তে আনা হয়। প্রায় ৩ লাখ ফরাসি নাগরিককে নাৎসিদের সহযোগিতা বা সহযোগী শাসনে কাজ করার অভিযোগে তদন্ত করা হয়। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পুলিশ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ।

বিচারিক প্রক্রিয়ায় অন্তত ৬ হাজার ৭৬৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বাস্তবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় অন্তত ৭৬৭ জনের। বাকি দণ্ড পরিণত হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মওকুফে। প্রায় ৪০ হাজার ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অনেককে আজীবন কারাগারে পাঠানো হয়। এ ছাড়াও সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, শিল্পী ও সরকারি কর্মকর্তাদের একটি বড় অংশকে চাকরিচ্যুত বা পেশা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। প্রখ্যাত অভিনেত্রী, লেখক, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ‘জাতীয় অপমান’ (Indignité nationale) মামলায় রায় হয়। ভিশি সরকারের প্রধান ফিলিপ পেতাঁ দেশদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদণ্ড পান। তবে বয়স (তখন ৮৯ বছর) ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বীরত্বের কারণে দণ্ড পরিবর্তন করে তাকে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। তিনি ১৯৫১ সালে বন্দি অবস্থায় মারা যান। ভিশি সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী পিয়েরে ল্যাভাল নাৎসিদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। ১৯৪৫ সালে ফায়ারিং স্কোয়াডে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আরও অনেক মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে দীর্ঘমেয়াদি সাজা দেওয়া হয়।

ফ্রান্সে ভিশি সরকারের সহযোগীদের বিরুদ্ধে বিচার ছিল বিশাল ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। হাজার হাজার মানুষকে জবাবদিহি করতে হয়, শত শত ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং আরও অনেককে সামাজিকভাবে বহিষ্কার করা হয়। এর মধ্য দিয়ে ফরাসি সমাজ নাৎসি সহযোগীদের শাস্তি দিয়ে নিজেদের জাতীয় মর্যাদা পুনর্গঠনের চেষ্টা করে।

শুধু নির্বাচনী প্রক্রিয়াতেই নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিটি স্তরে প্রশাসনকে দলীয়করণ ও ধ্বংস করেছে আওয়ামী লীগ। আমলাতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার বিভাগ- সবখানে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করেছে। নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হওয়ার অর্থ হলো গণতন্ত্রের মৃত্যু। অথচ জাতীয় পার্টি এ বিষয়ে একবারও সরব হয়নি।

প্রশাসনের দলীয়করণের বিরুদ্ধে কথা বলার পরিবর্তে তারা ক্ষমতার লোভে চুপ থেকেছে। সংসদে তাদের ভূমিকা ছিল প্রায় শূন্য। জনগণের কণ্ঠস্বর রক্ষার বদলে তারা সরকারের নীতির সঙ্গেই সুর মিলিয়েছে। এভাবে জাতীয় পার্টি কার্যত আওয়ামী লীগের সহায়তাকারী দলে পরিণত হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতীয় পার্টির ভূমিকা সেই ভিশি সরকারের সহযোগীদের মতোই। জাতীয় পার্টি জনগণের ভোটাধিকারকে পদদলিত করার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছে। প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা জনগণের সামনে এক ধরনের মিথ্যা গণতন্ত্র উপস্থাপন করেছে।

এ ছাড়া প্রশাসন ধ্বংস, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব, মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ- সব অন্যায়ের সময় জাতীয় পার্টি নির্লিপ্ত থেকেছে। নীরবতা এখানে নির্দোষ নয়; নীরবতা মানে সক্রিয় দালালি।

জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক কাঠামো আসলে শেখ হাসিনার ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। এইচএম এরশাদের হাতে জন্ম নেওয়া দল আজও সেই স্বৈরতান্ত্রিক সংস্কৃতির ধারক। জাতীয় পার্টির নেতাদের বিচারের ইস্যু সময়ের দাবি।

জাতীয় পার্টির দায় শুধু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয় নয়। এটি হলো ইতিহাসের নৈতিক দায় মেটানো। ফ্রান্স দখলের সময় ভিশি সরকারের সহযোগীদের বিচারের মাধ্যমে ফরাসিরা যেমন নিজেদের জাতীয় মর্যাদা পুনরুদ্ধার করেছিল, তেমনি বাংলাদেশকেও জাতীয় পার্টির দায় নির্ধারণ করতে হবে। শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার প্রক্রিয়ায় জাতীয় পার্টির সহযোগিতা এক ভয়াবহ অপরাধ। এই অপরাধের বিচার না হলে ভবিষ্যতে অন্য কোনো দল একই পথ অনুসরণ করতে দ্বিধা করবে না।

ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়- যারা জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, যারা স্বৈরশক্তিকে সহযোগিতা করে, তারা কখনও দায়মুক্ত হয় না।

আশরাফুল ইসলাম : ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের সময়