ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ান
প্রবাসী শ্রমিক নিজের চারপাশ অন্ধকার রেখে পরিবার ও দেশে আলো জ্বালিয়ে রাখেন। দিনের পর দিন পরিবারের মানুষদের মুখ না দেখে, কঠোর পরিশ্রম করে, মালিকদের গালমন্দ সহ্য করে, ঘামে ভেজা হাতে দেশে টাকা পাঠান। তাদের পরিশ্রম দেশের প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পে, বৈদেশিক রিজার্ভের প্রতিটি ডলারে অদৃশ্য অবদান রাখে। অথচ তারা দেশে ফিরে এলে বেকার থাকেন, কেউ তাদের কাজ দেয় না। সমাজ তাদের বিদেশ ফেরত বলে চেনে কিন্তু কেউ তাদের কষ্ট চেনে না। এই প্রবাস শ্রমিকদের হওয়ার কথা ছিল গর্বের প্রতীক কিন্তু তারা হন অবহেলিত।
বাংলাদেশ শ্রমনির্ভর উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় উৎস বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশি শ্রমিকরা মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, ইতালি, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করে এ দেশে টাকা পাঠান। কিন্তু দুঃখজনক, যারা অর্থনীতির মেরুদণ্ড, তারাই আজ অবহেলিত, তাদের জীবন আজ নানা সংকটের মধ্যে। প্রবাস জীবনে তাদের নিরাপত্তা নেই, দেশে ফেরার পরও তারা কোনো সুযোগ-সুবিধা পান না, পান না কাজের সুযোগও।
২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক রিপোর্টে দেখা যায়, প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে প্রায় ৬৫% রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। আইওএম-এর একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিবছর প্রায় ১০-১২ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যান এবং আরেকটি গবেষণায় দেখা যায় তাদের মধ্যে প্রায় ৬৫% বিভিন্নভাবে প্রতারণা, শোষণ ও শ্রম আইন লঙ্ঘনের শিকার হন।
ধরা যাক, নোয়াখালীর এক যুবক রুবেল শ্রমিক হিসেবে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন। চুক্তি হয়েছিল তাকে দেওয়া হবে ১৮০০ রিংগিত। কিন্তু এক বছর ধরে তাকে দেওয়া হয় ১২০০ রিংগিত। অফিসে অভিযোগ করেও কাজ হয়নি। একদিন তার হাত ভেঙে যায়। চিকিৎসা না পেয়ে ঋণের বোঝা আর কাজহীন অবস্থায় ফিরে আসেন দেশে। অথচ রুবেলই এক সময় দেশে বছরে ৫ লাখ টাকার বেশি পাঠিয়েছিলেন। তার পাঠানো টাকায় পরিবার বেঁচে ছিল, কাজে লেগেছিল দেশের। কিন্তু আজ সে নিজেই অনিশ্চয়তার শিকার। এ রকম ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
দালালের খপ্পরে পড়ে অনেকেই পরিকল্পনা ছাড়া বিদেশ যান। সেখানে গিয়ে যখন চাকরি মেলে না তখন অবৈধ কাজ করতে থাকেন, ধরা পড়েন এবং দেশে ফেরত পাঠানো হয়। আবার অনেক এজেন্সি মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে টাকা নেয় কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী কাজ দেয় না। বিদেশে গিয়ে দেখা যায় কাজ ভিন্ন, টাকা কম এবং থাকার পরিবেশও অমানবিক। যখন একজন শ্রমিক পাসপোর্ট হারান, বেতন পান না, মারধরের শিকার হন তখন তার একমাত্র ভরসা হয় দূতাবাস। কিন্তু সেখানেও অনেক সময় উপেক্ষা করা হয়। আইন সম্পর্কে কোনো জ্ঞান না থাকায় তিনি বুঝতে পারেন না কার কাছে যাবেন, কীভাবে নিজের অধিকার আদায় করে নেবেন। বেশ কয়েক বছর বাইরের দেশে কাজ করে যখন দেশে ফিরে আসেন তখন তার আর কোনো মূল্য থাকে না, সমাজের চোখে তিনি আর কিছুই নন। তার অভিজ্ঞতা, দক্ষতা কাজে লাগে না, বেঁচে থাকেন বহিষ্কৃত মুখ হয়ে।
রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার একসঙ্গে এগিয়ে এলে এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব। বিদেশে যাওয়ার আগে শ্রমিকরা যেন সঠিক কাজের প্রশিক্ষণ পান, শ্রম আইন ও অধিকার সম্পর্কে জানতে পারেন এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এতে প্রতারণা কমে আর মর্যাদা বাড়বে। দালালের প্রতারণা রুখতে কড়া নজরদারি, ডিজিটাল সিস্টেমে রেজিস্ট্রেশন এবং নিয়মিত তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে। একজন শ্রমিক যেন জানতে পারেন তিনি কোথায় যাচ্ছেন, কী কাজ করবেন এবং কেমন বেতন পাবেন, এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। দেশে ফিরে আসা প্রবাসীদের জন্য বিশেষ ঋণ, প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তা প্রকল্পের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তারা চাইলেই ছোট ব্যবসা শুরু করতে পারেন, নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নতুন করে জীবন গড়ে তুলতে পারেন।
শ্রমিকরা আমাদের জাতির অমূল্য সম্পদ। প্রবাসী শ্রমিক শুধু টাকা পাঠান না, তারা পাঠান তাদের নিজেদের জীবন, অগণিত স্বপ্ন, বুকের ব্যথা আর হারানো মুহূর্ত। তাদের কঠোর পরিশ্রম এবং অঙ্গীকারের মাধ্যমে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সমাজ ও রাষ্ট্র উভয় ক্ষেত্রেই তাদের যথাযথ মূল্যায়ন হয় না। উন্নয়ন প্রকৃত অর্থে তখনই হয় যখন তার মূল কারিগররা প্রাপ্য সম্মান ও সুযোগ পায়।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
এ কারণে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা সময়ের দাবি। রাষ্ট্রের উচিত তাদের জন্য নিরাপদ ও মানবিক অভিবাসন নিশ্চিত করা, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা এবং তাদের ত্যাগ ও অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করা।
আর আমাদের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের কষ্টের কথা মন দিয়ে শোনা এবং তাদের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া। তারা পাঠান আমাদের দেশের প্রাণ, যা আমাদের সবাইকে একত্রে বাঁধে। তাদের সম্মান করা আমাদের মানবতার পরিচয়। প্রবাসী শ্রমিকদের গায়ের ঘাম শুকিয়ে গেলে দেশের উন্নয়নও একদিন থেমে যাবে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
আরমীন আমীন ঐশী : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা