‌‘সবুজ সোনা’ মরিঙ্গা সুপারফুড চাষে বাংলাদেশের সম্ভাবনা

কবীর আহমেদ ভূঁইয়া
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:০৫
শেয়ার :
‌‘সবুজ সোনা’ মরিঙ্গা সুপারফুড চাষে বাংলাদেশের সম্ভাবনা

বাংলাদেশকে বলা হয় কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে যুক্ত। খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল ভিত্তি হচ্ছে কৃষি খাত। ধান, গম, পাট, ডাল কিংবা বিভিন্ন সবজি—এসব ঐতিহ্যবাহী ফসল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের জীবিকা ও সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু বিশ্ববাজারে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সম্ভাবনাময় কৃষিপণ্যের চাহিদা তৈরি হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে মরিঙ্গা (Moringa oleifera)—যা বাংলায় সাজনা বা সজনী নামে পরিচিত, বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দিয়েছে। আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এটি বহু আগে থেকেই চাষ হলেও, এখন আন্তর্জাতিক বাজারে ‘সুপারফুড’ হিসেবে মরিঙ্গার চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এর পাতা, ফলি, বীজ, শিকড় এমনকি বাকল—সবকিছুই ব্যবহারযোগ্য এবং পুষ্টি ও ওষুধি গুণসম্পন্ন।

আজকে বাংলাদেশ যদি মরিঙ্গা চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানিকে কৌশলগতভাবে গ্রহণ করে, তবে এটি শুধু কৃষির নতুন দিগন্তই নয়—জাতীয় অর্থনীতি, স্বাস্থ্য খাত ও বৈদেশিক আয়ের ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী অবদান রাখতে পারে।

মরিঙ্গা কী ও কেন সুপারফুড?

মরিঙ্গা গাছ মূলত গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলোতে জন্মায়। এটি দ্রুত বর্ধনশীল, খরা-সহিষ্ণু এবং খুব কম জমি ও পানিতেই ফলন দেয়।

পুষ্টিগুণ: ভিটামিন এ , গাজরের চেয়েও প্রায় ৪ গুণ বেশি।

ভিটামিন সি: কমলার চেয়েও ৭ গুণ বেশি।

ক্যালসিয়াম: দুধের চেয়েও ৪ গুণ বেশি।

আয়রন: পালং শাকের চেয়েও ৩ গুণ বেশি।

পটাশিয়াম: কলার চেয়েও ৩ গুণ বেশি।

প্রোটিন: ডিম ও মাছের কাছাকাছি মান।

স্বাস্থ্যগুণ: অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ও অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন।

ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের গ্লোকোজ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি।

শিশু ও নারীদের অপুষ্টি মোকাবিলায় কার্যকর।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মরিঙ্গাকে ‘Miracle Tree’ নামে আখ্যা দিয়েছে, কারণ এর প্রতিটি অংশ ওষুধি গুণসম্পন্ন এবং অপুষ্টি মোকাবিলায় পরীক্ষিত।

বাংলাদেশে মরিঙ্গা চাষের বর্তমান অবস্থা : বাংলাদেশে মরিঙ্গা ঐতিহ্যগতভাবে গ্রামীণ আঙিনার পরিচিত গাছ হলেও বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ এখনও সীমিত। চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, রংপুর, বরিশালসহ দেশের প্রায় সব অঞ্চলে মরিঙ্গা চাষ করা সম্ভব।

চাষের সুবিধা: মরিঙ্গা খুব কম সার, পানি ও পরিচর্যা প্রয়োজন।

উৎপাদন: একেকটি গাছে বছরে প্রায় ২০-২৫ কেজি পাতা এবং ৫০-৬০ কেজি ফলি উৎপাদন সম্ভব।

আয়: এক একর জমি থেকে বছরে প্রায় ৬–৮ লাখ টাকার মরিঙ্গা লিফ-পাউডার উৎপাদন করা যায়।

কৃষকরা ধান বা সবজির তুলনায় অনেক কম খরচে বেশি লাভ পেতে পারেন।

স্বাস্থ্য খাতে মরিঙ্গার সম্ভাবনা : বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে প্রায় ৩১% খর্বকায়, ২২% কম ওজন এবং নারীদের মধ্যে আয়রনের ঘাটতি একটি বড় স্বাস্থ্য সমস্যা (বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভে ২০২২)। মরিঙ্গা এই সমস্যা সমাধানে কার্যকর হতে পারে।

অপুষ্টি মোকাবিলা: মরিঙ্গার শুকনো পাউডার শিশুদের খিচুড়ি, দুধ বা স্যুপে মেশানো যায়।

নারীদের স্বাস্থ্য: গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের জন্য মরিঙ্গা প্রাকৃতিক ভিটামিন-খনিজের উৎস।

ডায়াবেটিস ও জীবনধারাজনিত রোগ: নিয়মিত মরিঙ্গা গ্রহণ রক্তে সুগার লেভেল ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। যদি বাংলাদেশের পুষ্টি কর্মসূচিতে মরিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তবে তা জাতীয় স্বাস্থ্য সূচকে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

আন্তর্জাতিক বাজারে মরিঙ্গার অবস্থান : বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসচেতন ভোক্তাদের মধ্যে মরিঙ্গার জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্র: মরিঙ্গা লিফ-পাউডার ও ক্যাপসুল স্বাস্থ্য সাপ্লিমেন্ট হিসেবে ব্যাপক চাহিদা সম্পন্ন।

ইউরোপ: অর্গানিক মরিঙ্গা চা, স্যুপ মিক্স ও হেলথ ড্রিঙ্ক খুবই জনপ্রিয়।

জাপান ও কোরিয়া: এনার্জি ড্রিঙ্ক ও স্কিনকেয়ার পণ্যে মরিঙ্গা ব্যবহার হয়।

মধ্যপ্রাচ্য: প্রাকৃতিক ভেষজ ও অর্গানিক পণ্যের বাজার দ্রুত বাড়ছে।

বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান এলিড মার্কেটিং রিসার্চের মতে, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী মরিঙ্গা বাজারের আকার ছিল প্রায় ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এটি দ্বিগুণ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।  

বাংলাদেশ এই বাজারে প্রবেশ করতে পারলে রপ্তানিতে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।

চাষ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের চ্যালেঞ্জ : বাংলাদেশে মরিঙ্গা চাষে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন- মানসম্মত চারা উৎপাদন ও বিতরণে ঘাটতি। 

কৃষকদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব। শুকানো, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সুবিধার অভাব। আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন (HACCP, GMP, ISO, Organic) অর্জনের জটিলতা। রপ্তানির বাজার সংযোগ ও ব্র্যান্ডিং ঘাটতি। এসব সমস্যা সমাধান না করলে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে।

কৃষকদের জন্য নীতি ও সহায়তা : মরিঙ্গা চাষকে জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হলে কৃষকদের জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি:

১. ডেমোনস্ট্রেশন প্লট: উপজেলা পর্যায়ে মডেল খামার স্থাপন।

২. সহজ ঋণ ও ইনপুট সহায়তা: বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে চারা বিতরণ, সেচ ও শুকানোর যন্ত্র সহায়তা।

৩. বাজার নিশ্চয়তা : প্রসেসিং কোম্পানি কৃষকের উৎপাদিত পণ্য নির্দিষ্ট দামে কিনে নেবে।

৪. প্রশিক্ষণ: পাতা সংগ্রহ, শুকানো ও প্রক্রিয়াজাতকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ।

৫. রপ্তানি সহায়তা: সরকারী পর্যায়ে সার্টিফিকেশন, শুল্ক ছাড় ও ব্র্যান্ডিং সাপোর্ট।


অর্থনীতিতে অবদান: ‘সবুজ সোনা’র জাতীয় সম্ভাবনা : বাংলাদেশে যদি মরিঙ্গা চাষ বড় আকারে শুরু হয়, তবে এর অর্থনৈতিক প্রভাব বহুমুখী হবে:

কৃষক আয় বৃদ্ধি: কম খরচে বেশি লাভ।

কর্মসংস্থান সৃষ্টি: চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন খাতে লাখো কর্মসংস্থান।

রপ্তানি আয়: বছরে কয়েকশ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।

স্বাস্থ্য সুরক্ষা: অপুষ্টি হ্রাস ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি।

গ্রামীণ উন্নয়ন: কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠার ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির পুনর্জাগরণ।


বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের করণীয়

ভারত: অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুতে বাণিজ্যিকভাবে মরিঙ্গা চাষ হচ্ছে, যা স্থানীয় কৃষকদের আয়ের প্রধান উৎস।

ফিলিপাইন: মরিঙ্গাকে ‘Malunggay’ নামে পরিচিত; খাদ্য শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত।

কেনিয়া ও নাইজেরিয়া: অপুষ্টি মোকাবিলায় জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচিতে মরিঙ্গা অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশের করণীয়: গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ। অর্গানিক সার্টিফিকেশন অর্জন। আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ। ‘Bangladesh Green Gold’ নামে ব্র্যান্ডিং।


নীতি সুপারিশ ও ভবিষ্যৎ কৌশল

১. গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মরিঙ্গা গবেষণা জোরদার করা।

২. রপ্তানি-উপযোগী প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলা।

৩. কৃষকদের জন্য সহজ ঋণ, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা।

৪. সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং ও বাজার সংযোগ।

৫. জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি কর্মসূচিতে মরিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করা।

বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সবুজ বিপ্লব : বাংলাদেশের কৃষি ইতিহাসে পাটকে বলা হতো “সোনালী আঁশ”। আজ সময় এসেছে নতুন একটি নাম উচ্চারণ করার—“সবুজ সোনা”—যা হলো মরিঙ্গা।

এটি শুধু একটি কৃষিপণ্য নয়; বরং স্বাস্থ্য সুরক্ষা, অপুষ্টি মোকাবিলা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রপ্তানির মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতির নতুন চালিকাশক্তি হতে পারে। সরকারের নীতি সহায়তা, কৃষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থাকলে মরিঙ্গা সত্যিই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কৃষি ও অর্থনীতির জন্য এক যুগান্তকারী শক্তি হয়ে উঠতে পারে।


লেখক: উন্নয়ন কৌশলবিদ / প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, ভূঁইয়া গ্লোবাল ফাউন্ডেশন