গণমাধ্যমের অবক্ষয় ও বিকল্প অভ্যুদয়

আদনান আরিফ সালিম
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
গণমাধ্যমের অবক্ষয় ও বিকল্প অভ্যুদয়

টেলিভিশন আর সংবাদপত্রের বিকল্প কোনো গণমাধ্যম হতে পারে আজ থেকে দেড় কিংবা দুই দশক আগে কেউ কল্পনাও করতে পারতেন না। প্রত্যন্ত এলাকায়ও অনেক মানুষ আগ্রহ নিয়ে টেলিভিশন সংবাদ দেখতেন। বারবার অ্যান্টেনা ঘোরানোর পরও সাদা-কালো টেলিভিশনের পর্দায় আসা সেই ঝিরঝিরে ছবিতেও তাদের সংবাদ দেখার আগ্রহ কমাতে পারত না। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ফ্যাসিবাদী আমলের মিথ্যাচার মানুষের এই আগ্রহকে নাই করে দেয়। ফ্যাসিবাদী আইকনের ঢপের কেত্তনের ভাঙা রেকর্ড বারবার শোনানো হয়ে গিয়েছিল গণমাধ্যমের জন্য অলিখিত এক রুটিন। এর পাশাপাশি ইতিহাসের প্রতিষ্ঠিত সত্য নিয়ে নিরন্তর মিথ্যা বলায় বিরক্ত-বিব্রত মানুষ সেই যে টিভিপর্দা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার পর আর সেদিকে তাকানোর কোনো আগ্রহ তাদের মধ্যে দেখা যায়নি সেভাবে।

টেলিভিশনের পাশাপাশি দৈনিক পত্রিকা কিংবা অনলাইন পত্রিকাগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। আর সেই সুযোগেই খুব সম্ভবত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টিউব সাইটকেন্দ্রিক ডিজিটাল সংবাদ পরিবেশনায় এক বিপ্লব ঘটে গেছে। এক সময় যে সংবাদ শুধু প্রচলিত মুদ্রিত সংবাদপত্র ও টেলিভিশন মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল ছিল, সেখানে বর্তমানে তা বিকল্প সংবাদমাধ্যমের দ্বারা নতুন আঙ্গিকে ধরা পড়ছে। বিকল্প সংবাদমাধ্যম বলতে এমন সব প্ল্যাটফর্মকে বোঝানো হয়, যা প্রচলিত মূলধারার সংবাদমাধ্যমের বাইরে থেকে সমাজের নানা সমস্যা, অসঙ্গতি এবং প্রতিকূলতা তুলে ধরে। এ ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ, ইউটিউব চ্যানেল, পডকাস্ট ইত্যাদি বিশাল ভূমিকা পালন করছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের কথা বলতে গেলে সেই সময় এই বিকল্প গণমাধ্যম ছিল মানুষের আস্থার সব থেকে ওপরের স্থানে।

বিকল্প সংবাদমাধ্যমের উত্থান শুরু হয়েছিল যখন মানুষের বিশ্বাস, মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা নিয়ে প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে কিছু অস্বচ্ছতা দেখা দেয়। বিশেষত, শক্তিশালী করপোরেট বা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রচলিত সংবাদমাধ্যমগুলোর নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করে। এই অবস্থায় কিছু মানুষ নিজেদের মতামত প্রকাশ করার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন। সমাজের নানা শ্রেণির মানুষের জন্য বিকল্প সংবাদমাধ্যম একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়, যেখানে তারা তাদের সত্যি ঘটনা বা নিজস্ব চিন্তা বিনামূল্যে শেয়ার করতে পারেন।

এদিক থেকে দেখতে গেলে বিকল্প সংবাদমাধ্যমের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তার স্বাধীনতা ও প্রচলিত সমাজের প্রতি অঙ্গীকার। প্রচলিত সংবাদমাধ্যমের তুলনায় এখানে তথ্য সরবরাহ এবং বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কিছুটা মুক্তভাবে কথা বলার সুযোগ থাকে। যেখানে মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো সরকারি অথবা করপোরেট স্বার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ, বিকল্প সংবাদমাধ্যম সাধারণত স্বতন্ত্র মতামত প্রকাশ করতে পারে। এর মধ্যে প্রতিবাদমূলক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়, যা প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের মধ্যে তেমন উপস্থাপন হয় না। বিকল্প সংবাদমাধ্যমের আরও একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার গতি এবং প্রভাব। যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, সে ক্ষেত্রে বিকল্প সংবাদমাধ্যম তাৎক্ষণিকভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সাড়া ফেলে। এটি প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের তুলনায় অনেক দ্রুত এবং বাস্তবসম্মত খবর প্রকাশ করতে সক্ষম। ফলে সাধারণ মানুষও তাদের মতামত বা পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হতে পারে। আর এই সুযোগে বিকল্পধারার গণমাধ্যম ধীরে ধীরে মূলধারার গণমাধ্যমকে ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে।

তবে এই সময়েই বিকল্প সংবাদমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি নানা নেতিবাচক দিক যেমন গুজব ছড়ানো নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। প্রতিবাদ এবং জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা এই মাধ্যম যখন ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করতে শুরু করে সেখানে সত্যের চেয়ে আদর্শ আর গোষ্ঠী কিংবা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব বড় হয়ে দেখা দেয়। ফলে সে ক্ষেত্রে এই মাধ্যম জনগণের ক্ষমতায়নের বিপরীতে নানাবিধ অসুস্থ ভাবধারার প্রতিনিধিত্ব শুরু করে।

বিকল্প সংবাদমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয় এর নির্ভুলতা বা বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। তখন নানা মহল থেকে প্রশ্ন তোলা হয় বিকল্প সংবাদ প্ল্যাটফর্ম থেকে তথ্য বিকৃতি বা ভুয়া খবর ছড়ানোর বিষয়টি সামনে রেখে। সবাই খেয়াল করে দেখে সাধারণ মানুষ সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে নানাবিধ অসত্য তথ্য বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। কিছু ক্ষেত্রে এই ধরনের বিকল্প সংবাদমাধ্যম সামাজিক বিভাজন বাড়াতে শুরু করে। অনেক বিকল্প সংবাদমাধ্যম বিভিন্ন রাজনৈতিক বা সামাজিক মতাদর্শের অনুসারী যে পক্ষপাতিত্ব বা পক্ষবদ্ধতা তৈরি করে তার থেকে উত্তরণ অনেকের জন্যই কঠিন হয়ে দেখা দেয়। এই সময় বিভিন্ন স্যাটায়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং খবরের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া নিউজ সাইটের আবির্ভাব ঘটে, যাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিক্রিয়া হয়ে ওঠে সুদূরপ্রসারী।

স্যাটায়ার পেজ ও সাইটগুলো সাধারণত মূলধারার সংবাদমাধ্যমের সরবরাহকৃত তথ্যগুলোকে হাস্যরস বা বিদ্রƒপের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে থাকে। কখনও কখনও তারা এমন একটি সত্য বা অর্ধসত্য তথ্য উপস্থাপন করে, যা বাস্তব ঘটনা নয়, কিন্তু তা সমাজে এমনভাবে উপস্থাপিত হয় যেন সেটি বাস্তব সত্য মনে হয়। ফলে অনেক সময় জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে যায় এবং সঠিক খবর থেকে ভুল তথ্য গ্রহণ করে। এ ছাড়া স্যাটায়ারের মাধ্যমে খবরের মোড় ঘুরানোর আরও একটি দিক হলো মানুষের মনোভাবের পরিবর্তন। কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক ঘটনাকে স্যাটায়ারের মাধ্যমে হাস্যকর করে তোলা, তা সেই ঘটনার গুরুত্ব বা প্রভাব কমিয়ে দেয়। ফলে সাধারণ মানুষ সেই বিষয়ে কম মনোযোগ দেয় এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনসাধারণের মধ্যে অবহেলা তৈরি হতে পারে।

সম্প্রতি শুধু সংবাদ নিয়ে নয়, গণমাধ্যমের নাম নিয়েও যাচ্ছেতাইভাবে স্যাটায়ার করায় বিভ্রান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে পাঠকদের। যেমন একটি টিভি চ্যানেলের লোগো ও নামের সঙ্গে মিল রেখে ধারাবাহিকভাবে তৈরি করা হয়েছে আনোয়ার টিভি, ঝামেলা টিভি, ঝংকারটিভি, জানোয়ার টিভি, প্রথম আলু, দিল্লিস্টার, নিউজ নাই টুয়েন্টিফোর, চেন্নাই টুয়েন্টিফোর, মাজাভাঙা টেলিভিশন, আমাদের অসময়, দুঃসময় টিভি, বাইশে টেলিভিশন, হ্যাংলাভিশন, জংলাভিশন, ডিবি সিসি টিভি, আমার কেশ, ফুটন্ত টেলিভিশন, বাহাত্তর টিভি মতো উদ্ভট নামের খুব কাছাকাছি লোগোর নানা ফেসবুক পেজ।

এসব ফেসবুক পেজ মূলত নানারকম রংবেরঙের নিউজসংবলিত ফটোকার্ড শেয়ার দিয়ে থাকে। তার থেকেও মজার বিষয় হিসেবে প্রতিটি ফটোকার্ডে থাকে নানাবিধ বিজ্ঞাপনও। যেমন, অনেক ফটোকার্ডের নিচে লেখা থাকে ‘পতনজ্বলি আয়ুর্বেদিক : প্রথম অর্ডারে গর্ত খোঁড়ার বেলচা ফ্রি’ কিংবা ঝিম বার, এক ঘষাতেই করে জীবাণুদের তেলচর্বি পরিষ্কার, সিম্পহর্নি মোবাইল : নষ্ট হবে আবার কিনবেন, রেন্ডি ১৪ মোবাইলসহ আরও অদ্ভুত ও ভুতুড়ে সব লাইন। এই নিউজভিত্তিক পেজগুলো নিছক মজা করার উদ্দেশ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে সমস্যা ছিল না। এই পেজ থেকে নিয়মিত ছড়ানো হয় বিভিন্ন ধরনের প্রোপাগান্ডা ও মিথ্যা তথ্য।

প্রচুর হাস্যরসে ভরপুর তথ্যের মধ্যেও দেখা যায় নির্লজ্জ মিথ্যাচার এবং সত্য-মিথ্যার মিশেলে চেরিপিকিং করে তৈরি নিউজ। বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরি করা এসব নিউজ সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। ফলাফল হিসেবে দেখা যাচ্ছে, গণমাধ্যমের অবক্ষয় দেখে তরুণ প্রজন্ম যে বিকল্প ধাঁচের গণমাধ্যমের অভ্যুদয়ের চেষ্টা করেছিলেন তার উদ্দেশ্যে অনেকটাই এসব ফেসবুক পেজের মাধ্যমে এখন পরিপালিত হচ্ছে। কিন্তু সেগুলোর বিপজ্জনক ব্যবহার, মিথ্যাচার, চরিত্রহনন আর আক্রমণাত্মক দৃষ্টি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারলে এর থেকেও উপযুক্ত সফলতা আসতে পারে। আর তখনই কেবল বিকল্পধরার গণমাধ্যম হিসেবে এগুলোর অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে; নচেৎ নয়।


ড. মো. আদনান আরিফ সালিম : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়