জরিপে ভোটারদের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষণীয়

আবুল হাসনাত মোহা. শামীম
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
জরিপে ভোটারদের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষণীয়

বাংলদেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজনৈতিক আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে বহু আগেই। সম্প্রতি আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে জনমতের যে পালাবদল, তা নিয়ে অনেকগুলো জরিপের আয়োজন করেছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। সেগুলো এক গভীর রাজনৈতিক সংকেত বহন করছে। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও ভয়েস ফর রিফর্মের যৌথ জরিপে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা কেবল ভোটের হিসাব নয়- এটি জনগণের রাজনৈতিক আস্থা ও প্রত্যাশার দিক থেকেও প্রশ্নসাপেক্ষ।

গত বছরের অক্টোবরে যেখানে ৩৮ শতাংশ মানুষ জানিয়েছিল, তারা এখনও কাকে ভোট দেবে ঠিক করেনি, সেখানে আট মাস পর সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশে। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক ভোটার এখনও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতার ঘোরে আচ্ছন্ন। এটি একদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার ইঙ্গিত, অন্যদিকে দলগুলোর জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থতার প্রমাণ। একই সঙ্গে ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ মানুষ সরাসরি বলেছে, তারা তাদের ভোটের পছন্দ প্রকাশ করতে চায় না, যা রাজনৈতিক পরিবেশের ভেতরে ভয়, অবিশ্বাস বা অনিশ্চয়তার উপস্থিতি নির্দেশ করে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, গত সরকারের পতনের মাত্র বছর পার না হতেই দেশের জনপ্রিয়তম দলের ভোট কমে গিয়ে তলানিতে ঠেকেছে। এ ধরনের বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান নিঃসন্দেহে কোনো শুভবুদ্ধির পরিচয় বহন করে না।

জরিপের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ভোটারদের সমর্থনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। বিএনপির সমর্থন ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ থেকে নেমে ১২ শতাংশে, জামায়াতের ১১ দশমিক ৩০ থেকে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশে, আর আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) সমর্থন ৮ দশমিক ৯০ থেকে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। তুলনায় ক্ষুদ্র হলেও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সামান্য উত্থান দেখিয়েছে- ২ থেকে ২ দশমিক ৮০ শতাংশে। এই ওঠানামা প্রমাণ করে, প্রথাগত রাজনীতির গ-িতে জনগণের আস্থা ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছে, আর নতুন বিকল্পের প্রতি এক ধরনের সতর্ক কৌতূহল জন্ম নিচ্ছে। তবে ‘আপনার এলাকায় কে জিতবে বলে মনে হয়’ প্রশ্নে বিএনপি ৩৮ শতাংশ, জামায়াত ১৩ শতাংশ, এনসিপি ১ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগ ৭ শতাংশ সমর্থন পেয়েছে, যা ইঙ্গিত করে যে, জনগণের ভোটদানের ইচ্ছা ও জয়ের সম্ভাবনার ধারণা সব সময় এক নয়। অর্থাৎ নির্বাচনী ফলাফল অনুমান ও ভোটদানের মনোভাবের মধ্যে একটি ফাঁক তৈরি হয়েছে, যা রাজনৈতিক পরিস্থিতির জটিলতাকে আরও স্পষ্ট করে।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে দেশের গতিপথ নিয়েও আস্থার পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বিগত অক্টোবরে রাজনৈতিকভাবে সঠিক পথে আছি বলে মনে করেছিল ৫৬ শতাংশ মানুষ, যা এখন নেমে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশে। তবে অর্থনৈতিকভাবে সঠিক পথে আছি বলে যারা মনে করে, তাদের সংখ্যা সামান্য বেড়ে ৪৫ শতাংশ হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মক্ষমতা নিয়েও জনমতের টানাপড়েন স্পষ্ট। অক্টোবরে সরকারকে গড়পড়তা ৬৮ নম্বর দেওয়া হলেও বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৬৩-তে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ৫১ শতাংশ মানুষ বলছে, তারা সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার পরই নির্বাচন চায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন, পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ও বেকারত্ব কমানোর মতো ক্ষেত্রগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এটি স্পষ্ট করে যে, জনগণের কাছে নির্বাচন শুধু ভোটদানের প্রক্রিয়া নয়, বরং একটি কাঠামোগত পরিবর্তনের অংশ। তবু আশাবাদের জায়গা রয়ে গেছে। জরিপে ৭০ শতাংশ মানুষ এখনও বিশ্বাস করছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। এই বিশ্বাস হয়তো রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি সুযোগ- ভোটারদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে। কিন্তু একই সঙ্গে এটি একটি সতর্কবার্তাও। কারণ এই আস্থার ভঙ্গুরতা যে কোনো মুহূর্তে হতাশায় রূপ নিতে পারে, যদি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয়। সব মিলিয়ে এই জরিপের বার্তা সুস্পষ্ট- বাংলাদেশের ভোটাররা এখন পরিবর্তনের প্রত্যাশায়, কিন্তু সেই পরিবর্তনের দিক ও নেতৃত্ব নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তায় রয়েছে। প্রথাগত দলগুলো যদি তাদের পুরনো কৌশল আঁকড়ে ধরে থাকে, তবে এই সিদ্ধান্তহীন জনগোষ্ঠী হয়তো নতুন রাজনৈতিক শক্তির খোঁজে নামবে অথবা ভোটদানে অনাগ্রহী হয়ে উঠবে। তাদের এই প্রবণতা দূর করতে হলে রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে গিয়ে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে আগ্রহী হতে হবে। এলাকার মানুষের কাছে চিহ্নিত ব্যক্তিকে দলীয় প্রতীকের জোরে পার করে আনার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে গেছে। আগামী নির্বাচন তাই কেবল একটি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নয়, এটি জনগণের আস্থা পুনর্গঠনের পরীক্ষা, যা ব্যর্থ হলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত তৈরি হতে পারে। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামনে এখন দুটি পথ- একটি হলো আস্থা পুনর্গঠনের জন্য সংস্কার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির পথ বেছে নেওয়া, আরেকটি হলো পুরনো বিভাজনের রাজনীতিতে আটকে থেকে জনগণের প্রত্যাশাকে উপেক্ষা করা। পথ কোন দিকে যাবে, সেটিই আগামী দিনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে জনগণের আশা ও আকাক্সক্ষার প্রতিফলন যে রাজনৈতিক দলটি দেখাতে পারবে, নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারাই এগিয়ে থাকবে। তবে তরুণদের আগ্রহ-উদ্দীপনা ও চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব প্রদান করলে তারা নির্বাচনী দৌড়ে কিছুটা আপার হ্যান্ডে থাকবে, সেটা আগে থেকেই অনুমান করে নেওয়া যায়।


অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত মোহা. শামীম : গবেষক ও ট্রেজারার, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়