যানজট এড়াতে কেবল কার: বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন সমাধান

কবীর আহমেদ ভূঁইয়া
০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২২:৩৩
শেয়ার :
যানজট এড়াতে কেবল কার: বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন সমাধান

সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৮০ মিলিয়ন। প্রতিদিন জনসংখ্যা বাড়ছে, কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাবে বেকারত্ব ও অসহায়ত্বও বাড়ছে। শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু কর্মসংস্থান পর্যাপ্ত নয়। কর্মসংস্থানের আশায় প্রতিদিন হাজারো মানুষ পাড়ি দিচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে।

আজকের ঢাকা বিশ্বের অন্যতম যানজটপূর্ণ শহর। টমটম ট্রাফিক ইনডেক্স (২০২৪) অনুযায়ী একজন সাধারণ নাগরিক প্রতিদিন গড়ে ২–৩ ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকেন। বিশ্বব্যাংকের (২০২৩) সমীক্ষায় দেখা গেছে, যানজটের কারণে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ৩–৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অর্থাৎ, যানজট শুধু সময় ও উৎপাদনশীলতা ক্ষতি করছে না, বরং জাতীয় অর্থনীতির ওপরও বিশাল চাপ সৃষ্টি করছে।

ঢাকার সড়ক অবকাঠামো শহরের মোট আয়তনের মাত্র ৭ শতাংশ, যেখানে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী কমপক্ষে ২৫–৩০ শতাংশ থাকা প্রয়োজন। জনসংখ্যার চাপ, জমির সীমাবদ্ধতা ও দুর্বল নগর পরিকল্পনার কারণে নতুন সড়ক নির্মাণ প্রায় অসম্ভব। ফলে ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে বা মেট্রোরেল দিয়ে যানজট নিরসন করা সম্ভব হচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে বিকল্প পরিবহন ব্যবস্থা আবিষ্কার করা জরুরি। সেই বিকল্প হিসেবে কেবল কার পরিবহন বাংলাদেশে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

গত এক দশকে সরকার মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার প্রভৃতি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তবে দুর্নীতি, সময়ক্ষেপণ ও দক্ষতার অভাবে এসব প্রকল্পের ব্যয় কয়েকগুণ বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মেট্রোরেল (MRT-6) প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৩,০০০ কোটি টাকা। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ২০১১ সালে শুরু হলেও আংশিক চালু হয়েছে ২০২৩ সালে। এসব উদ্যোগ আংশিক সুফল দিলেও যানজট সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আনতে পারেনি।


বিশ্বের বিভিন্ন শহরে কেবল কার আধুনিক নগর পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে কার্যকর হয়েছে।

লা পাজ, বলিভিয়া: বিশ্বের সবচেয়ে বড় আরবান কেবল কার নেটওয়ার্ক, যেখানে ১১ লাইন ও ৩৩ কিমি ট্র্যাকে প্রতিদিন ৩ লক্ষাধিক যাত্রী চলাচল করে। পাহাড়ি এলাকায় রাস্তা নির্মাণের সীমাবদ্ধতার কারণে কেবল কারই কার্যকর সমাধান হয়েছে।

মেদেলিন, কলম্বিয়া: কেবল কার চালুর পর বস্তি এলাকার মানুষ সহজে শহরে যাতায়াত করতে পারছে। প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার যাত্রী ব্যবহার করছে, ফলে সামাজিক অন্তর্ভুক্তি বেড়েছে, অপরাধ কমেছে।

ইস্তাম্বুল ও পোর্তো: পর্যটন ও ব্যবসায়িক এলাকায় কেবল কার নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

হংকং: কেবল কার শুধু পরিবহন নয়, পর্যটনের প্রধান আকর্ষণেও পরিণত হয়েছে।

ভারত: দার্জিলিংয়ের সাফল্যের পর বারাণসী ও উত্তরাখণ্ডে নগর কেবল কার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

লাগোস, নাইজেরিয়া: যানজট নিরসনে কেবল কার প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন, যা প্রতিদিন লক্ষাধিক যাত্রী বহন করবে।


নগরপরিবহনে কেবল কার: দ্রুত, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব সমাধান-

বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, কেবল কার শহরের যানজট ও পরিবহন সমস্যার জন্য কার্যকর বিকল্প।

বিশেষজ্ঞদের মতে:

নির্মাণ খরচ: মেট্রোরেলের তুলনায় ৪–৫ গুণ কম।

বাস্তবায়নের সময়: মাত্র ২–৩ বছরে যাত্রী পরিবহন সম্ভব, যেখানে মেট্রোরেলের জন্য প্রায় ৮–১০ বছর লাগে।

অর্থনৈতিক প্রভাব: দৈনন্দিন যানজটজনিত ক্ষতি কমবে, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে।

PPP মডেল: বিদেশি বিনিয়োগ সহজে আনা যাবে।

পরিবেশবান্ধব: বিদ্যুৎচালিত হওয়ায় কার্বন নিঃসরণ সর্বনিম্ন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কেবল কার শুধু নগর পরিবহন নয়, অর্থনীতি, পরিবেশ ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি শক্তিশালী করার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

সামাজিক অন্তর্ভুক্তি: নিম্ন আয়ের মানুষও দ্রুত ও সাশ্রয়ী যাতায়াতের সুযোগ পাবে।


পর্যটন উন্নয়ন: কক্সবাজার, সিলেট, বান্দরবান প্রভৃতি এলাকায় কেবল কার পর্যটনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে।

সফল বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও প্রয়োজনীয়তা-

১. প্রযুক্তিগত সক্ষমতা: পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদ নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক যন্ত্রপাতি এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া স্থায়ী কার্যকারিতা সম্ভব নয়।

২. নিরাপত্তা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়ঝঞ্ঝা বা অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত বিকল্প ব্যবস্থা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে।

৩. রাজনৈতিক সদিচ্ছা: স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধের ব্যবস্থা প্রকল্পের সফলতা নিশ্চিত করবে।

৪. অর্থায়ন: রাষ্ট্রীয় বাজেটের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা একত্রিত করা প্রয়োজন।


প্রকল্পের সাফল্য প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, নিরাপত্তা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং যথাযথ অর্থায়ন—এই চারটি ভিত্তির ওপর নির্ভরশীল। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করলে কেবল কার দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

বাংলাদেশে কেবল কার বাস্তবায়ন: সম্ভাব্য কর্মপরিকল্পনা-

পাইলট প্রকল্প: ঢাকায় মিরপুর–মতিঝিল ও উত্তরা–ধানমন্ডি, চট্টগ্রামে বহদ্দারহাট–পতেঙ্গা করিডর। দ্রুত সুফল প্রদান করবে।

আন্তঃজেলা সংযোগ: ঢাকা–নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা–নরসিংদী, ঢাকা–ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকা–গাজীপুর। নগর ও উপনগর অঞ্চলের কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিল্প ও কর্মসংস্থানে নতুন সম্ভাবনা।

অর্থায়ন ও বিনিয়োগ: PPP মডেল ব্যবহার করে বেসরকারি খাত ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব।

মানবসম্পদ উন্নয়ন: দেশীয় প্রযুক্তি ও রক্ষণাবেক্ষণ দক্ষতা গড়ে তুলতে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: প্রতিটি ধাপে আন্তর্জাতিক মানের অডিট বাধ্যতামূলক।

আজকের বাংলাদেশে যানজট শুধুমাত্র নগর জীবনের অসুবিধা নয়, বরং জাতীয় উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। প্রচলিত অবকাঠামোগত সমাধান দিয়ে এই সংকট সমাধান সম্ভব নয়।

কেবল কার পরিবহন হতে পারে এক অভিনব, কম খরচে, দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য, পরিবেশবান্ধব এবং দীর্ঘমেয়াদি টেকসই সমাধান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে—কেবল কার কেবল যানজট নিরসনই করে না, বরং অর্থনীতি, সমাজ, পরিবেশ ও পর্যটনকেও গতিশীল করে।

বাংলাদেশ যদি এখনই সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে কেবল কার দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক নতুন যুগের সূচনা করবে। সেই যুগে নগর জীবন সহজতর হবে, অর্থনীতি গতিশীল হবে, এবং বাংলাদেশ প্রবেশ করবে টেকসই উন্নয়নের নতুন অধ্যায়ে।

রাজনৈতিক সদিচ্ছা, স্বচ্ছ অর্থায়ন এবং সঠিক পরিকল্পনা নিশ্চিত হলে কেবল কার পরিবহন বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে।


কবীর আহমেদ ভূঁইয়া

রাজনৈতিক ও উন্নয়ন কৌশলবিদ, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, ভূঁইয়া গ্লোবাল ফাউন্ডেশন।