সবার জন্য মানসম্মত চিকিৎসা: বিএনপির ৩১ দফা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিপ্লব
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য, টিকাদান এবং সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি সত্ত্বেও আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা এখনো দুর্বল, খণ্ডিত ও অকার্যকর। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের - বিএনপি ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচি স্বাস্থ্য খাতকে জাতীয় উন্নয়নের মূল ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেস, “মানসম্মত চিকিৎসা পাওয়ার আগেই কোনো মৃত্যু নয়”।
এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বিএনপি পরিকল্পনা নিয়েছে সারা দেশে আধুনিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার, যেখানে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি PHC ইউনিট এবং প্রতিটি শহুরে ওয়ার্ডে একটি PHC ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হবে।
এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নেটওয়ার্কের মূল লক্ষ্য শুধু চিকিৎসা দেওয়া নয়, বরং প্রতিরোধ, সচেতনতা ও আগাম সনাক্তকরণকে অগ্রাধিকার দেওয়া। বর্তমানে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যঝুঁকির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অসংক্রামক রোগ (NCDs), ক্যান্সার, শিশুদের অপুষ্টি জনিত খর্বতা (stunting) এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রতিটি PHC ইউনিটে নিয়মিতভাবে রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, সারভিক্যাল ক্যান্সার, স্থূলতা, অপুষ্টি ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি শনাক্তের স্ক্রিনিং করা হবে। এছাড়া শিশুদের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ, পুষ্টি পরামর্শ, টিকাদান, স্কুলভিত্তিক স্বাস্থ্যশিক্ষা, কিশোরী ও কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য সাপোর্ট এবং সচেতনতা কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণের স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি করা হবে। এভাবে রোগের প্রসার প্রতিহত করা যাবে, খরচসাপেক্ষ চিকিৎসার প্রয়োজন কমবে, পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক চাপ হ্রাস পাবে এবং মানুষ আরও সুস্থ ও কর্মক্ষম হয়ে উঠবে।
ডিজিটাল উদ্ভাবন বিএনপির স্বাস্থ্য বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিটি নাগরিকের হাতে থাকবে একটি ই-হেলথ কার্ড, যা জাতীয় ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ড সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। এর মাধ্যমে রোগীর সমস্ত স্বাস্থ্যতথ্য, চিকিৎসা ইতিহাস এবং সেবা প্রাপ্তি রেকর্ড সংরক্ষণ হবে। একইসঙ্গে চালু করা হবে ইলেকট্রনিক রেফারেল সিস্টেম, যা ইউনিয়ন পর্যায়ের PHC ইউনিট থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল এবং তৃতীয় স্তরের বিশেষায়িত হাসপাতালে স্মার্ট ও নিরবচ্ছিন্ন রেফারেল নিশ্চিত করবে। এই প্রযুক্তি-নির্ভর ব্যবস্থার ফলে সেবার গুণগত মান বাড়বে, অপ্রয়োজনীয় পুনঃপরীক্ষা কমবে এবং রোগীরা সময়মতো মানসম্মত চিকিৎসা পাবেন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বাংলাদেশের জন্য এই সংস্কার এখন অপরিহার্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৪ সালের তথ্যানুযায়ী, দেশের মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশের বেশি অসংক্রামক রোগের কারণে ঘটে। ইউনিসেফ (২০২৩) এর তথ্যে দেখা যায়, ৫ বছরের নিচে শিশুদের মধ্যে ২৩ শতাংশ খর্বতা বা stunting-এ ভুগছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষা ও উৎপাদনশীলতার জন্য বড় হুমকি। একইসঙ্গে, ১৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত সেবা না থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব সমস্যা অচিহ্নিত থেকে যায়। শক্তিশালী PHC নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রতিরোধমূলক সেবা, পুষ্টি সহায়তা, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা, টেলিমেডিসিন এবং আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর চিকিৎসা সহজলভ্য হবে।
এই পরিকল্পনার মূল দর্শন হলো “সবার জন্য সমান স্বাস্থ্য অধিকার”। বিএনপির লক্ষ্য হলো প্রতিটি ইউনিয়ন ও প্রতিটি শহুরে ওয়ার্ডে PHC ইউনিট স্থাপন করে মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া। টেলিমেডিসিন কিয়স্ক, প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী, আধুনিক ডায়াগনস্টিক টুলস এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পাবেন। এর ফলে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত হবে, দ্রুত রোগ শনাক্তকরণ সম্ভব হবে এবং হাসপাতালগুলোর ওপর চাপও কমবে।
বিএনপির ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচি স্পষ্টভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মানুষের ওপর বিনিয়োগ, প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার এবং প্রযুক্তিনির্ভর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার। তারেক রহমানের ভিশনের লক্ষ্য একটি দক্ষ, সমতাভিত্তিক ও মানুষের কেন্দ্রীকৃত স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের ই-হেলথ কার্ড থাকবে, প্রতিটি PHC ইউনিট ডিজিটালি সংযুক্ত থাকবে, প্রতিটি রেফারেল হবে নিরবচ্ছিন্ন, এবং কোনও নাগরিক মানসম্মত চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করবে না।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
এটি শুধু স্বাস্থ্য সংস্কার নয়, এটি একটি জাতীয় অঙ্গীকার—যেখানে প্রতিরোধ, প্রযুক্তি, দক্ষতা ও সমতা একসাথে কাজ করবে। শক্তিশালী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি সুস্থ, উৎপাদনশীল ও স্থিতিশীল জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে।
লেখক: বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ