মূল্যস্ফীতির ছোবলে সব সূচক বরবাদ

মোস্তফা কামাল
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
মূল্যস্ফীতির ছোবলে সব সূচক বরবাদ

বাড়বাড়ন্তের সিরিজে দেশে দারিদ্র্য বাড়ছে, রিজার্ভও বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি তো বাড়ছেই। নৈরাজ্যও বাড়ছে। কমছে টাকার মান, মানুষের দাম। কমতে কমতে বিনিয়োগ থমকেই গেছে। বিনিয়োগে স্থবিরতা দেশের অর্থনীতি, সমাজ, জীবনাতিপাতকে সরাসরি প্রভাবিত করছে। কর্মসংস্থান ব্যাহত হওয়ায় গড় ভোগান্তি বেড়েছে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকট, ঋণের ব্যয় বৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং জ্বালানি সংকটের কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ পতনের দিকে। আচানক না হলেও এটাই বাস্তব। বাড়তে বাড়তে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩১৪৩২ দশমিক ০৮ মিলিয়ন বা ৩১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার।

এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গত বুধবারের সর্বশেষ হিসাব। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ৩১৪৩২ দশমিক ০৮ মিলিয়ন ডলার। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ এখন ২৬৪৫০ দশমিক ০৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর আগের দিন গত ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১৩৮৮ দশমিক ১২ মিলিয়ন ডলার। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ছিল ২৬৩৯৯ দশমিক ৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর সমান্তরালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের তেজ ভয়াবহ। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মতে, দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে নেই, কিন্তু একেবারে ওপরে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অনেকে নাক বরাবর পানিতে দাঁড়িয়ে আছে, সামান্য ঢেউ এলেই তলিয়ে যাবে।

এ সংক্রান্ত হিসাব কাছাকাছি। ব্যাখ্যায়ও তফাত কম। ২০২২ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ, যা বর্তমানে ২৭.৯৩ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ প্রতি চারজনে একজন এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে। একই সময় চরম দারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৩৫ শতাংশে। প্রায় ১৮ শতাংশ মানুষ এমন অবস্থায় আছে, যে কোনো সময় তারা দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে যেতে পারে। হিসাবে গ্রাম-শহর ভেদ আছে। শহরের পরিবারের গড় আয় কমেছে, কিন্তু ব্যয় বেড়েছে। ২০২২ সালে মাসিক আয় যেখানে ছিল ৪৫ হাজার ৫৭৮ টাকা, বর্তমানে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৫৭৮ টাকায়। কিন্তু খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার টাকায়। এর বিপরীতে গ্রামে আয় সামান্য বেড়েছে। খরচের ৫৫ শতাংশ চলে যাচ্ছে শুধু খাদ্যে, ফলে সঞ্চয়ের কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বেকারত্বের হার বেড়ে হয়েছে ৪.৬৩ শতাংশ। দেশে বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখে। নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় এ হার আরও উদ্বেগজনক। একই সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩.৯৭ শতাংশে, যা কোভিডকাল বাদ দিলে গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। প্রথমবারের মতো প্রকাশিত বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকের (এমপিআই) তথ্যে দেখা যায়, অন্তত চার কোটি মানুষ আয় ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মৌলিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত।

এ সূচক অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ শতাংশ। ১৮ বছরের নিচে শিশুদের মধ্যে এ হার ২৯ শতাংশ, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ২১ শতাংশ। গ্রামে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার ২৭ শতাংশ হলেও শহরে তা ১৩ শতাংশ। বান্দরবানে এ হার সবচেয়ে বেশি, ৬৫ শতাংশ। হিসাব ও সূচকের হেরফের থাকলেও বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাসের প্রবণতা তিন দশক ধরে চললেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেখানে এখন উল্টা মোড়। নতুন গবেষণায় দেখা যায়, দেশে বর্তমানে প্রতি চারজনের একজন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, দারিদ্র্যে না নামা ওই তিনজনের একটি বড় অংশ এমন পরিস্থিতিতে আছে সামান্য আঘাত-অসুস্থতা, চাকরি হারানো কিংবা হঠাৎ কোনো সংকট তাদের দরিদ্রের কাতারে নামিয়ে আনবে।

জনশুমারি অনুযায়ী ২০২২ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৭ কোটি, পরিবারের সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ। সেই হিসাবে অন্তত পৌনে ৫ কোটি মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে। জনসংখ্যা বাড়ায় প্রকৃত সংখ্যা আরও বড়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস দারিদ্র্য পরিমাপের ক্ষেত্রে যে সূচক ব্যবহার করে, তাতে একজন মানুষের প্রতিদিন গড়ে অন্তত ২ হাজার ১২২ ক্যালরির খাবার ও ন্যূনতম খাদ্যবহির্ভূত খরচ মেটানো প্রয়োজন। বাস্তবে খাদ্যের দাম অঞ্চলভেদে ভিন্ন ও ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় অনেকেরই এই মানদণ্ড ঠিক থাকে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। একটি পরিবারের মাসিক আয়ের প্রায় ৫৫ শতাংশ এখন শুধু খাবার কিনতেই খরচ হয়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়ও বাড়ছে। ফলে আয়ের তুলনায় ব্যয় বাড়তে থাকায় সঞ্চয়ের সুযোগ কমে যাচ্ছে। জরিপে উঠে এসেছে, প্রায় ৪০ শতাংশ পরিবারের ঋণের বোঝা আগের তুলনায় বেড়েছে। এতে তাদের আর্থিক নিরাপত্তা আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ পরিস্থিতি শুধু দরিদ্র জনগোষ্ঠীকেই নয়, নিম্নমধ্যবিত্তকেও নতুন করে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর অপ্রিয় নিষ্ঠুর সত্য হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হলেও তার সুফল সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছেনি। ‘উচ্চ আয়ের মানুষের আয় দ্রুত বেড়েছে, কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় তেমন বাড়েনি। মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষ ওপরে উঠতে পারেনি, অনেকে আবার নিচে নেমে গেছে। কয়েক বছর ধরে খাদ্য, জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েছে।

দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের পরিবার তাদের আয়ের বড় অংশ খাবারে খরচ করায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারছে না। এ ছাড়া শিল্প ও সেবা খাত সম্প্রসারণ হলেও পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। বিপুলসংখ্যক তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও তাদের জন্য স্থায়ী ও মানসম্মত কাজের সুযোগ সীমিত। ফলে তারা অনানুষ্ঠানিক ও কম আয়ের কাজের সঙ্গেই যুক্ত হচ্ছে। দেশে সরকারি, বেসরকারি, দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগ না বাড়া পর্যন্ত অর্থনীতির এসব সূচকে স্থবিরতা আসবে না। এটি বুঝতে অর্থনীতিক হওয়া লাগে না। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের মানুষ বোঝে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি মূলত জোগান বৃদ্ধির কারণে হলেও বিনিয়োগ স্থবির থাকায় এ প্রবৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী হচ্ছে না। বর্তমান রিজার্ভ বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ বিদেশি মুদ্রার জোগান বৃদ্ধি এবং বিনিয়োগের দুর্বলতা। প্রবাস আয় বেড়েছে, আবার মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। ফলে বাজারে ডলার সরবরাহ বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংককে কিনে নিতে হচ্ছে, যাতে দামের অস্বাভাবিক পতন না ঘটে। এ নিয়ে কারও কারও মধ্যে এক ধরনের বড়াই থাকলেও এটি অর্থনীতির প্রাণশক্তি নয়, চাহিদার দুর্বলতার প্রতিফলন। এ রিজার্ভকে টেকসই করতে হলে জরুরি হলো প্রকৃত রিজার্ভের হিসাব প্রকাশে স্বচ্ছতা বজায় রাখা। একই সঙ্গে বিনিয়োগবান্ধব রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা। রেমিট্যান্স প্রবাহকে আনুষ্ঠানিক পথে দীর্ঘমেয়াদি করতে না পারলে ফুলে ওঠা রিজার্ভ আগামী দিনের জন্য মরীচিকা হয়ে দেখা দেবে।

মুদ্রাস্ফীতির যাতনায় পিষ্ট মানুষের অর্থনীতির এসব মাইক্রো-ম্যাক্রো হিসাব শোনার সময় নেই। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতিহারা মানুষ দিশাহারা। যতসামান্য আয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যাচ্ছে মৌলিক প্রয়োজন খাদ্য কিনতে। বাকিটা দিয়ে বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা। বিনোদন গোল্লায়। বাড়তি দুটা আয়ের জন্য নৈতিক-অনৈতিক নানা যুদ্ধ। দুই-তিন বছর ধরে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। এনবিআরও তেল, আলু, পেঁয়াজ, ডিমসহ বেশকিছু নিত্যপণ্যে শুল্ক-কর কমিয়ে দেয়। বাজারে নিত্যপণ্যের আমদানিপ্রবাহ ঠিক রাখার চেষ্টা করা হয়। চেষ্টায় কমতি-ঘাটতি নেই। কিন্তু সাফল্য আসছে না সেভাবে। অভাবী, জীবনের ঘানি টানতে কাহিল এসব মানুষ সমাজে অযোগ্যের খাতাভুক্ত হচ্ছে, তা নিজেরাও উপলব্ধি করছে। এসব মানুষের দাম কমার সমান্তরালে টাকার দামও কমছে। এই অবমূল্যায়ন ধরে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, ডলার সস্তা হলে তা মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হতো। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই হস্তক্ষেপ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মহামারীর পর থেকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। এর ফলে আমদানি ব্যয় বাড়ে এবং নিত্যপণ্যের দামে চাপ সৃষ্টি হয়। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে চলে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে তা কিছুটা কমলেও ভোক্তাদের ভোগান্তি কমেনি।


মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলামিস্ট