বীজ উৎপাদনে কেন্দ্রগুলোর কাজ কী
গোলে আক্তার নাজমা। ছিলেন শিক্ষিকা। বছরখানেক আগে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে অবসরে গেছেন। গত বছর লাউ ও কুমড়া গাছে বরাবরের মতো বস (বীজের জন্য রাখা লাউ ও কুমড়ার নাম বস।) রেখেছিলেন। প্রতিবছরের মতো এ বছরও গ্রামের ২০-২৫ জন নারীর মধ্যে বীজ বিনিময় করেছিলেন। সেই বীজ থেকে গাছ হয়েছে ঠিকই কিন্তু লাউ আর কুমড়ার দেখা নেই।
ফুলকপির বীজের কেজি এ বছর দেড় লাখ টাকা। গত বছর প্রতিটি ফুলকপির চারার দাম পড়েছে ২ টাকা। অথচ একটা কপি থেকে ১শ গ্রাম বীজ পাওয়া যায়। ১০ গ্রামে ৩ হাজারটি দেশি জাতের বীজ পাওয়া যায়। একটি ফুলকপির বীজে এক উপজেলার ৩০ হাজার পরিবারের এক দিনের চাহিদা পূরণ হয়। তাহলে ৩৬৫ দিনের চাহিদা পূরণ করতে মাত্র ৩৬৫টি ফুলকপি হলেই সম্ভব। ১শ দিন ধরলে একটি উপজেলায় গড়ে ১শটি ফুলকপিই বীজের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টি বাঁধবে কে?
দুই.
সুস্বাদু দেশি পাঙ্গাশ ছাপিয়ে কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল থাই পাঙ্গাশ, প্রথম আলোর বরাতে এই খবর আমরা জেনেছি গত ১৩ জুলাই। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দেশি পাঙ্গাসকে সাধারণের জন্য সহজলভ্য করার সম্ভাবনা তৈরি করেছিলেন সে সময়কার তরুণ মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ খলিলুর রহমান। ১৯৮৭ সালে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাঁদপুরের নদী কেন্দ্রে যোগ দেন তিনি। পরের বছর দেশি পাঙ্গাশের কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ কৌশল প্রণয়নের দায়িত্ব পড়ে তার ওপর।
২০০৪ সালের জুনে সেটি সম্ভব করেন। কিন্তু চার মাসের মাথায় এই পোনা পুকুর থেকে ‘রহস্যজনকভাবে’ চুরি হয়ে যায়। এরপর আর কর্তৃপক্ষ এটিকে এগিয়ে নেয়নি। উল্টো ১৯৯০ সালে থাইল্যান্ড থেকে আনা পাঙ্গাশের পোনার কৃত্রিম প্রজননের দায়িত্বও খলিলুর রহমানকে দেওয়া হয়। তিন বছরের মধ্যে সে কাজে সফল হন তিনি। এই সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি রাষ্ট্রীয় পদক পান। কী দুর্ভাগ্য আমাদের!
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কমিটিগুলোতে কৃষকের কোনো প্রতিনিধি নেই। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্যই উৎপাদন করতে পারে না, কিন্তু জাতির খাদ্য চাহিদা পূরণের অঙ্গীকার করে বসে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উন্নত জাতের নামে রাসায়নিক সার, বিষ ও ভূগর্ভস্থ পানি লাগে এমন জাত আবিষ্কারেই ব্যস্ত। জনগণের টাকায় বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থে গবেষণা করাই যে কাজ।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বাংলাদেশে খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো কাউন, যবের মতো এমন কয়েক প্রজাতির উদ্ভিদ হারিয়ে গিয়ে টিকে আছে মাত্র ধান, গম আর ভুট্টা। ফলে এগুলো দিয়েই খাদ্যের জোগান হচ্ছে। সেই প্রজাতিগুলোকেই টিকিয়ে রাখা হয়েছে, রাসায়নিক সার, বিষ ও সেচযন্ত্রে ভালো ফল দেয় এবং দীর্ঘ পরিবহনে টিকে থাকে। একই কথা প্রাণীদের বেলায়ও। ভাওয়াইয়া শিল্পী কছিম উদ্দীনের গানে যেসব মাছের নাম পাওয়া যায়, সেসব মাছ আর নেই।
উন্নয়নের ঠেলায় আর খুশিতে মাগনা চা খাওয়ার গল্পের মতো নামমাত্র মূল্যে হাইব্রিড বীজ হাজির হয়েছে আগে। তার পর কৃষকের গোলা বীজহীন করে, কোম্পানিকে বীজ উৎপাদনের দায়িত্ব দিয়ে সামাজিক সৌহার্দ্য আর সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে মানুষ। ফলে আনন্দমুখর উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে জনগণ হলো বিচ্ছিন্ন। জমি ও স্বাস্থ্যকর খাবার থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হলো। এমনকি কেড়ে নেওয়া হলো কী আবাদ করবে সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণেরও অধিকার। বীজ উৎপাদনের জ্ঞান ও কর্মসংস্থানের যে সুযোগ গ্রামে ছিল, তা ডাকাতি করে নিল কোম্পানিগুলো। আর সরকারি কর্তারা হলেন কোম্পানির এজেন্ট।
তিন.
প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে শস্য ও বীজ সংরক্ষণাগার আছে। কাজ ছিল- উন্নত মানের বীজ সংরক্ষণ ও বিতরণ, কৃষকদের বীজ উৎপাদনে সহায়তা প্রদান, শস্য ও বীজের গুণগত মান রক্ষা। অথচ হাইব্রিড বীজের উৎপাদন সক্ষমতা যাচাই, নজরদারি ও সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থাও নেই। কৃষক কেমন বীজ জমিতে লাগাচ্ছেন, সেটা দেখভাল করাই ছিল তার কাজ।
সরকারি নার্সারিগুলোতে আগ্রাসী প্রজাতির উদ্ভিদ ছিল এতকাল। বনবিভাগের লোকরা বনকে বাগান বলেন। উপদেষ্টা রেজোয়ানা হাসানকে ধন্যবাদ, তিনি সরকারি নার্সারিগুলো থেকে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনিকে নিষিদ্ধ করেছেন। নার্সারিগুলোতে যত বেশি সম্ভব বিরল ও নানা প্রজাতির চারা উৎপাদনের জন্য নির্দেশনা দরকার।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
আরডিআরএস বাংলাদেশ গ্রামীণ সংঘ প্রজেক্টের আওতায় সীমান্ত এলাকায় ও শহরে কৃষিবিজ্ঞান, কমিউনিটি প্রশিক্ষণ, স্থানীয় উদ্যোগ এবং পুষ্টিসচেতনতা উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে।
অথচ এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিটি কৃষক পরিবারকে বীজ উৎপাদনে যুক্ত করে স্থানীয় জাতগুলোর ওপর গুরুত্ব দিলে খাদ্য নিরাপত্তাচক্র শক্তিশালী হয়। উদ্ভিদ ও গবাদিপশুর স্থানোপযোগী জাত জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ করে। স্থানীয় বীজের সঙ্গে স্থানীয় খাবারের সম্পর্ক আছে। স্থানীয় খাবার স্বাস্থ্যকর। কারণ তা পরিবহন করে আনার প্রয়োজন পড়ে না। তাই রাসায়নিক বিষমুক্ত থাকে।
আর উৎপাদক যেহেতু সরাসরি ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রি করে, ফলে একদিকে বীজে ভেজাল দেওয়ার সুযোগ নেই, অন্যদিকে প্রক্রিয়াজাত, মোড়কজাত ও হিমঘরে সংরক্ষণেরও দরকার পড়ে না। এতে জ্বালানি ব্যবহার কম পড়ে, কম বর্জ্য উৎপন্ন হয়। বন্যপশু ও পাখিরা ভালো থাকে।
উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ও দার্শনিক ফরহাদ মজহারের ‘উবিনীগ’ আর কৃষক দেলোয়ার জাহানের ‘প্রাকৃতিক কৃষি’র সদস্যরা গ্রামের জনগণকে বোঝান যে, নিজেদের জমি, পরিষ্কার পানি, উর্বর জমি এবং টেকসই পদ্ধতিতে খাদ্য ও ফসল উৎপাদনের জন্য দরকারি জ্ঞানের মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো নিয়ে কাজ করছেন। কাজ করছেন স্থানীয় জ্ঞান ও দক্ষতার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায়। সত্যিকারের উন্নয়ন, টিকে থাকার সক্ষমতা সৃষ্টি ও ন্যায্যতা সৃষ্টির জন্য তাদের শিক্ষা কাজে লাগানো উচিত। ফরিদা আপা, আর কবে?
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
নাহিদ হাসান : লেখক ও সংগঠক