মুখ চেপে ধরে মনোবল ফেরাতে চাইছে পুলিশ
বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা- এই বাংলা প্রবাদের কথা আমরা অনেকেই জানি। বিপদে-আপদে পড়ে থানায় বা পুলিশের কাছে গেলে মানুষের আশ্বস্ত হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে কতটুকু হয়, সেই বিষয়টি পরিষ্কার করে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত এই প্রবাদবাক্য। সম্প্রতি পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যের একটি ঘটনা পুলিশ বিষয়ে এই ধারণাকে আরও শক্ত করেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মিথ্যাচার।
রাজধানী ঢাকায় প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের সময় এক বিক্ষোভকারীর মুখ চেপে ধরার যে ছবি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সেটি ‘এআই জেনারেটেড’ বলছে পুলিশ। পুলিশের ভাষ্য, ‘জনমনে বিভ্রান্তি তৈরির জন্য’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে এ ছবি তৈরি করা হয়েছে। আদতে এ রকম কোনো ‘ঘটনা ঘটেনি’। বাস্তবতা হচ্ছে, ঢাকার অন্তত তিনটি দৈনিকের তিনজন ফটো সাংবাদিক বলছেন, তারা প্রত্যেকেই ঘটনাস্থলে থেকে ওই ঘটনার ছবি তুলেছেন। পুলিশের এমন নির্লজ্জ মিথ্যাচার মূলত নির্বোধের কাজ। তিন দফা দাবিতে আন্দোলনরত প্রকৌশলের শিক্ষার্থীরা শাহবাগে জড়ো হয়েছিলেন। তাদের সামনের কাতারে ছিলেন মূলত বুয়েট শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তারা মিছিল নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার দিকে যেতে থাকলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘাত বাধে। পুলিশ লাঠিপেটা করে, টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। ওই সময় কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পুলিশ ঘিরে ধরে মারধর করছে- এমন কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আলম এক শিক্ষার্থীর মুখ চেপে ধরেছেন, এমন একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে।
আমরা স্মরণ করতে পারি, বুয়েটের আন্দোলনের সময় মুখ চেপে ধরা এই ছবিটির সঙ্গে গত বছরের জুলাই আন্দোলনের সময়কার একটি মুখ চেপে ধরা ছবির মিল রয়েছে। এই ছবি কী বার্তা দিল? গণ-অভ্যুত্থানের আগের সময়কার পুলিশের মতো এখনকার পুলিশও মুখ চেপে কণ্ঠরোধের চেষ্টা চালাচ্ছে? তাহলে পুলিশের আচরণের বদল হলো কী? গত বছরের জুলাই আন্দোলনের সময়কার আলোচিত ওই ছবিটি ছিল শাহবাগ থানার এক পুলিশ কর্মকর্তার। তিনি হাইকোর্টের সামনে এক আন্দোলনকারীর মুখ চেপে ধরেছিলেন। এখনও ঢাকার রাস্তায় সেই ছবিটি গ্রাফিতি, কার্টুন হিসেবে আমাদের সামনে হাজির আছে। কণ্ঠরোধের প্রতীক হয়ে ওঠা সেই ছবির পুনঃমঞ্চায়ন আমরা দেখতে পেলাম। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে- মুখ চেপে ধরার ছবি নিয়ে পুলিশ এখন পুরো ঘটনা অস্বীকার করে পাল্টা অভিযোগ তুলছে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সম্প্রতি ডিএমপির রমনা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলমকে নিয়ে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি এক ছাত্রের মুখ চেপে ধরার একটি ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কে বা কারা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলকভাবে ওই ছবিটি তৈরি করে জনমনে অহেতুক বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেছে। ছবিটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যায়, তা সম্পূর্ণ এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি এবং বাস্তবতাবিবর্জিত।’
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরির উদ্দেশ্যে তৈরি ছবি ও তা প্রচারের সঙ্গে জড়িতদের এহেন কর্মকা-ের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানায় ডিএমপি। একই সঙ্গে এ ধরনের মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বসাধারণকে অনুরোধ করা হলো।’ পুলিশের এই বিবৃতি আমাদের হতবাক করেছে।
কোনো ছবি এআই দিয়ে তৈরি করা কিনা, তা যাচাইয়ের জন্য বেশকিছু অ্যাপ রয়েছে। এর মধ্যে ‘সাইট ইঞ্জিন’ নামের একটি অ্যাপ দিয়ে ছবিটি যাচাই করা হয়। অ্যাপটি বলছে, এই ছবিটি এআই জেনারেটেড নয়। আমরা আরও উল্লেখ করতে পারি- বৃহস্পতিবার মানবজমিন পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে মুখ চেপে ধরার সেই ছবি। ছবিটি তুলেছেন মানবজমিনের ফটো সাংবাদিক আবু সুফিয়ান জুয়েল। এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রতিদিনের ফটো সাংবাদিক জয়ীতা রায়ও তার ফেসবুকে ছবিটি শেয়ার করেছেন। বুয়েটের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে পুলিশের বলপ্রয়োগের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীরা রমনা বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আলমের শাস্তি দাবি করেছেন। ঘটনার পর ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বুধবার রাতে শাহবাগে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে দুঃখ প্রকাশও করেছেন। কিন্তু পুরো ঘটনা কী ইঙ্গিত দিল? এখানে প্রশ্নটি সোজা। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে যখন পুলিশি ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছিল, চুরি-ডাকাতির ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছিল, তখন কিন্তু দেশের সাধারণ নাগরিকরাই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। নিজেরা নিজেদের বাড়ি-ঘর পাহারা দিয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, পুলিশ আবার রাস্তায় সোচ্চার হয়েছে। পুলিশের মারমুখী আচরণ ছাড়া তাদের দায়িত্ব পালনের আর কোনো চিত্র আমরা মনে করতে পারছি না।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে পুলিশকে চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। বিশেষ করে, চব্বিশের জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় দমন-পীড়ন ও হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে পুলিশকে তীব্র জনরোষের মুখে পড়তে হয়েছিল। গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ধাক্কা পুলিশ এখনও সামলাতে পারেনি বলে মনে করা হচ্ছিল। পুলিশ সদস্যদের মধ্যে মনোবলের ঘাটতি আছে বলে আলোচনা আছে। কিন্তু সম্প্রতি পুলিশের মারমুখী আচরণ এবং মুখ চেপে ধরার চিত্র আগের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। বিষয়টা এমন যে, পুলিশ আছে পুলিশের মতোই। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশ সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেখানে পুলিশের আচরণের সংস্কারের বিষয়টি কি উপেক্ষিত রয়ে গেল কিনা- এমন প্রশ্নও দেখা দেবে বৈকি!
এহ্সান মাহমুদ: নির্বাহী সম্পাদক, আমাদের সময়; কথাসাহিত্যিক
আরও পড়ুন:
লরির ধাক্কায় পুলিশ সদস্য নিহত