ভেজাল কসমেটিকস চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য

এম এন আলম
৩০ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
ভেজাল কসমেটিকস চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য

বাহারি গেটআপ, বিদেশি লেভেল আর নামিদামি ব্র্যান্ডের আকর্ষণীয় মোড়কে থরে থরে সাজানো রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কসমেটিকসের দোকানগুলো। তবে খালি চোখে বোঝার উপায় নেই কোনটি আসল আর কোনটি নকল। পুরান ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এসব নকল কসমেটিকস তৈরির কারখানা রয়েছে। আর একটি অসাধু চক্র দেশি-বিদেশি বিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের পরিত্যক্ত কৌটায় নকল প্রসাধনী ঢুকিয়ে কম দামে বাজারজাত করছে। কম দামে পাওয়ায় ব্র্যান্ডের কসমেটিকস মনে করে ভোক্তারাও তা দেদার ক্রয় করছে।

নকল-ভেজাল প্রসাধনীতে মাত্রাতিরিক্ত মার্কারি, সিসা, স্টেরয়েড ও হাইড্রোকুইনোনসহ নানান ক্ষতিকারক রাসায়নিক থাকায় তা ব্যবহারে কারও মাথার চুল পড়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত প্যারাবেনসযুক্ত প্রসাধনীর দীর্ঘ ব্যবহারের ফলে শরীরে হরমনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়, ফলে প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। ফর্সা হতে গিয়ে আবার কারও মুখের চামড়া সাদা হয়ে যাচ্ছে অথবা চেহারায় স্থায়ী কালো দাগ পড়ে যাচ্ছে। গর্ভবতী মহিলারা এসব প্রসাধনী ব্যবহারের ফলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম দিচ্ছে। নকল-ভেজাল কসমেটিকস দীর্ঘদিন যাবৎ ব্যবহার করলে স্কিন ক্যানসারসহ লিভার ও কিডনির জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কিছুদিন আগে জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানির বেবি পাউডারে ক্ষতিকর ক্যানসারের উপাদান থাকায় আমেরিকার বাজার থেকে কোম্পানিটি বেবি পাউডারটি প্রত্যাহার করে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ৭০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ প্রদান করে। উন্নত বিশে^ শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ থাকায় কোম্পানিগুলো খুব সতর্কতার সঙ্গে বিধিবিধান মেনে কসমেটিকস উৎপাদন ও বাজারজাত করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে নকল-ভেজাল নিম্নমানের কসমেটিকস বাজারজাত করার দায়ে আমদানিকারক বা উৎপাদনকারী কোম্পানি কর্তৃক পণ্যটি প্রত্যাহার ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের নজির নেই বললেই চলে।

ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বাংলাদেশে কসমেটিকস খাতের বাজার প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার, এর মধ্যে কালার কসমেটিকসের চাহিদা ১৩ হাজার কোটি টাকার এবং স্কিন কেয়ার পণ্যের চাহিদা প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার। ওই পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায় যে, মাত্র ১০ হাজার কোটি টাকার প্রসাধনী বৈধভাবে আমদানি হয়ে থাকে, বাকি ২৪ হাজার কোটি টাকার কসমেটিকস প্রসাধনী লাগেজ পার্টির মাধ্যমে চোরাইপথে দেশে প্রবেশ করে। সেই হিসাবে ৭০ শতাংশ কসমেটিকস্ পণ্যের বাজার কালোবাজারিদের দখলে। এভাবে নকল-ভেজাল কসমেটিকস তৈরি এবং শুল্ক ফাঁকির মাধ্যমে আমদানির ফলে ক্রেতারা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি সরকারও হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

নানান বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বাংলাদেশে গার্মেন্ট, ওষুধ, চামড়া, হিমায়িত মৎস্য ও প্লাস্টিকশিল্পে বিস্তর উন্নয়ন ঘটে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে বিশে^র ১৫০টিরও বেশি দেশে ওষুধসহ উল্লেখিত পণ্যগুলো রপ্তানি হচ্ছে। পিছিয়ে পড়া কসমেটিকসশিল্পকে অন্যান্য শিল্পের মতো এগিয়ে নিতে বিগত সরকারগুলো নানান পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিগত সংসদে ওষুধ ও কসমেটিকস্ আইন-২০২৩ পাস করা। ওই আইনের ২(৮) ধারায় কসমেটিকসের সংজ্ঞায় ওষুধ সংশ্লিষ্ট প্রসাধন সামগ্রী এবং ৩১-৩৫ ধারায় কসমেটিকসের উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ, নিবন্ধন এবং বিজ্ঞাপন সম্পর্কে বিশদ বিবরণ রয়েছে। তাছাড়া নকল-ভেজাল কসমেটিকস উৎপাদন ও বাজারজাতকারীদের ৫ বছরের কারাদ- ও ৫ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। আইনটি প্রণয়নকালে সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) এবং ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ)-এর মধ্যে রশি টানাটানি শুরু হয়। বিএসটিআইর মতে, নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তক্রমে দীর্ঘদিন যাবৎ তারা প্রসাধনী পণ্যের ছাড়পত্র প্রদান করে আসছে। অপরদিকে ডিজিডিএর মতে, বেশির ভাগ কসমেটিকস ত্বকের মাধ্যমে শোষিত হয়ে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে কার্যকর হয় বিধায় বিষয়টি জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত এবং আমেরিকা, কানাডা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, জাপান ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশের ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কসমেটিকস সামগ্রী নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাই কসমেটিকস সেক্টরটি স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকা উচিত।

সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সন্দেহ-সংশয় থাকায় এবং মেডিকেটেড ও নন-মেডিকেটেড কসমেটিকসের তালিকা বা আমদানির শর্তাবলি আইন বা বিধিতে সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত না থাকায় নকল-ভেজাল কসমেটিকস উৎপাদন ও বাজারজাতকারীরা সুযোগের সৎ ব্যবহার করছে। ফলে নকল-ভেজাল ও নিম্নমানের অবৈধ কসমেটিকসে বাজার সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। ওষুধ ও কসমেটিকস আইন-২০২৩ কার্যকর হওয়ার প্রায় দুই বছর অতিক্রান্ত হলেও নকল-ভেজাল কসমেটিকস্ উৎপাদনকারী-বাজারজাতকারীদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের জেল-জরিমানার খবর পাওয়া যায়নি। ফলে নকল-ভেজাল কসমেটিকস চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতা থাকলেও সম্প্রতি আমেরিকায় পোশাক রপ্তানি শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নির্ধারণ করাটা বর্তমান সরকারের একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পুলিশ সংস্কার কমিশন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা নিরসনে কাজ শুরু করেছে। সরকার ইতোমধ্যে মামলার দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করে মামলাজট ও জনগণের ভোগান্তি লাঘবে দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধিতে ব্যাপক সংশোধনী এনে মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন করেছে।

কসমেটিকসগুলো জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বিধায় বিএসটিআই ও ডিজিডিএ-এর মধ্যে রশি টানাটানি বন্ধ করে তাদের মধ্যকার আইনগত বিরোধ ও বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিরসন করে উন্নত বিশে^র আদলে একটি নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে। এর জন্য বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধান সংশোধন করে প্রয়োজনে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সমস্যার আশু সমাধান হতে পারে। যথাযথ পরিকল্পনা এবং পলিসি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য রপ্তানি খাতের মতো কসমেটিকসশিল্পও বিশ^বাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্ট মহল আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

ড. এম এন আলম : সাবেক উপপরিচালক ও আইন কর্মকর্তা, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ঢাকা।