শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক খেলার মাঠ থাকা অপরিহার্য
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে ১,২৬৫ জন মানুষ বসবাস করে, যা বৈশ্বিক গড়ের প্রায় ২০ গুণ। এই সীমিত ভূমিতে প্রতিটি ইঞ্চি জমি পরিকল্পিত, বিজ্ঞানসম্মত এবং শিশু-কিশোরবান্ধবভাবে ব্যবহার করা এখন একটি বাস্তব চ্যালেঞ্জ। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম- শিশু ও কিশোরদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশের জন্য প্রতিটি এলাকায় খেলার মাঠ থাকা অপরিহার্য।
খেলাধুলা কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়; এটি শিশুদের জন্য এক ধরনের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা। খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুরা আত্মনিয়ন্ত্রণ, সহনশীলতা, নেতৃত্বগুণ, দলগত চেতনা ও সহমর্মিতা অর্জন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত শরীরচর্চা শিশুদের শেখার সক্ষমতা, মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে নিশ্চিত করা হয়, প্রতিটি শিশু যেন প্রতিদিন পার্ক, মাঠ বা উন্মুক্ত স্থানে খেলতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে এই ধারণার বাস্তবায়ন এখনও অনেকাংশে পিছিয়ে আছে।
বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাধুলার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। শহরের মতো গ্রামাঞ্চলের বহু স্কুল-কলেজেও প্রয়োজনীয় খেলার জায়গা অনুপস্থিত। আর যেসব স্কুলে মাঠ আছে, সেগুলো অনেক সময় ছোট বা প্রভাবশালীদের জবরদখল ও অব্যবস্থাপনার কারণে কার্যকর থাকে না। ফলে শিশুরা মাঠে দৌড়ঝাঁপের পরিবর্তে মোবাইল ফোন, টিভি ও ইন্টারনেটনির্ভর গেমসে বেশি সময় কাটাচ্ছে। এর ফলে জন্ম নিচ্ছে স্থূলতা, মানসিক অস্থিরতা, একঘেয়েমি ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা।
প্রতিটি ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুর জন্য দৈনিক অন্তত এক ঘণ্টা মাঝারি থেকে উচ্চমাত্রার শারীরিক কার্যকলাপ অপরিহার্য। কিন্তু দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এর জন্য কোনো উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই। যেখানে শিশুরা প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠার সুযোগ পেত, সেখানে তারা এখন চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কোচিং, অ্যাপ, গেমস, ফেসবুক ও ইউটিউব- এই প্রযুক্তিনির্ভরতার মধ্যে তাদের শৈশব সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।
জমির অভাব নয়, পরিকল্পনার অভাবই বাংলাদেশের বড় সমস্যা। একদিকে বাড়ছে ঘরবাড়ি, ধর্মীয় স্থাপনা ও বাজার; অন্যদিকে শিশুদের খেলার জায়গা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক মাঠের ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্প্রসারণে বাস্তবধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। খেলাধুলা শুধু শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য নয়; এটি সামাজিক সম্প্রীতি, নেতৃত্ব বিকাশ এবং অপরাধপ্রবণতা রোধেও কার্যকর।
বর্তমানে অনেক এলাকায় দেখা যায়- একাধিক ঈদগাহ থাকলেও ভালো খেলার মাঠ নেই। অথচ ঈদগাহ মাঠ বছরে মাত্র দুই দিন ব্যবহার হয়। বছরের বাকি সময় এগুলো যদি শিশুদের খেলাধুলার জন্য উন্মুক্ত রাখা যায়, তা হলে একই জমির বহুমুখী ও কার্যকর ব্যবহার সম্ভব। প্রয়োজনে আইনগত প্রক্রিয়ায় ঈদগাহ মাঠকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহায়ক ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহারযোগ্য করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
আমরা লক্ষ করেছি, দেশের ক্যাডেট কলেজগুলো দেখিয়েছে- যেখানে শারীরিক কসরত ও খেলাধুলা নিয়মিত ও বাধ্যতামূলক, সেখানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষায় যেমন উৎকর্ষ দেখায়, তেমনি কর্মজীবনেও সাফল্যের স্বাক্ষর রাখে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক মাঠ গড়ে তোলা এবং প্রতিটি স্কুল-কলেজে ক্যাডেট কলেজের আদলে কালক্ষেপণ না করে শারীরিক কসরত বাধ্যতামূলক করা অপরিহার্য।
শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের অ্যাসেম্বলি ক্লাস খেলার মাঠেই আয়োজন করা যেতে পারে। এতে তারা সকাল থেকেই শারীরিক কসরত, শৃঙ্খলা, দেশাত্মবোধক গান ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে। একই সঙ্গে নিয়মিত শরীরচর্চাকে মূল্যায়ন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। যেমন, বার্ষিক বা সেমিস্টার পরীক্ষার অংশ হিসেবে শারীরিক সক্ষমতার ওপর নির্দিষ্ট নম্বর রাখা যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা ও শরীরচর্চাকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করবে এবং শারীরিক সুস্থতাকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অংশ হিসেবে ভাবতে শিখবে।
সমাধান ও সুপারিশ
১. যেসব এলাকায় একাধিক ঈদগাহ রয়েছে অথচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাধুলার উপযুক্ত মাঠ নেই, সেখানে অতিরিক্ত ঈদগাহের জমিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত করে মাঠ হিসেবে ব্যবহার করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
২. ঈদগাহ মাঠগুলোকে বছরের বাকি সময় খেলার জন্য উন্মুক্ত রাখা যেতে পারে। এতে শিশুদের জন্য পরিবেশবান্ধব ও সুরক্ষিত খোলা জায়গা নিশ্চিত হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
৩. মুসলমানদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুই ঈদের জামাত স্থানীয় স্কুল-কলেজ মাঠেই আয়োজন করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। এতে যত্রতত্র ঈদগাহ নির্মাণ কমবে এবং জমির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
৪. যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব মাঠ নেই, সেগুলোর পাশে থাকা সরকারি খাস জমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে রূপান্তরের জন্য প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
৫. স্থানীয় প্রশাসন, শিক্ষা বিভাগ, ওয়াকফ বোর্ড, ইউনিয়ন পরিষদ ও ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে একটি সমন্বিত মাঠ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এতে মাঠ স্থাপন উদ্যোগের বাস্তবায়ন ও পরবর্তী তদারকি সহজ হবে।
শিশুদের খেলাধুলার অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে শুধু তাদেরই নয়, পুরো জাতির উপকার হবে। কারণ খেলাধুলা মানেই শুধু শরীরচর্চা নয়- এটি একটি সুস্থ, সচেতন ও সহনশীল প্রজন্ম গঠনের অন্যতম ভিত্তি। প্রতিটি এলাকায় খেলার মাঠ নিশ্চিত করা এখনই জাতীয় অঙ্গীকার হওয়া উচিত। আমাদের সন্তানরা যেন মোবাইলের আলো নয়, প্রকৃতির আলোয় বড় হয়ে উঠতে পারে, সেটিই নিশ্চিত করতে হবে।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে মাঠ সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে খেলার মাঠ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা জরুরি। সুস্থ-সবল প্রজন্ম গঠন শুধু স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্ব নয়। এটি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক মাঠ গড়ে তোলা একটি জাতীয় আন্দোলনে পরিণত করতে হবে।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
তবেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হবে শারীরিকভাবে সুস্থ, কর্মক্ষম এবং সৃজনশীল। বিশ্ব মানচিত্রে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে এটি হবে অন্যতম পূর্বশর্ত।
মো. মাহবুবুর রহমান : সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ফরিদপুর সিটি কলেজ