বিজয় থ্যালাপ্যাথির পদযাত্রা যে বার্তা দেয়
দাক্ষিণাত্যের চলচ্চিত্রে চিরচেনা অভিনেতা, অনেকের প্রিয় মুখ বিজয় ইলায়াথ্যালাপ্যাথি ওরফে বিজয় থ্যালাপ্যাথির সাম্প্রতিক শোডাউন সামাজিক মাধ্যমে ঢেউ তুলেছে। বর্তমানে ভারতের ক্ষমতাসীনদের আমরা যে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করতে দেখি, তার সঙ্গে বিজয়ের সমাজ-সংস্কৃতি ও শিক্ষার এক মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য বোঝার জন্য ইতিহাসে ফিরে তাকানো জরুরি। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদেরও চরিত্র গড়ে তোলে সমাজ ও সংস্কৃতি, আর সেই সূত্রেই তৈরি হয় আলাদা ধারা।
উপমহাদেশের আঞ্চলিক রাজ্যগুলোর মধ্যে হায়দ্রাবাদ ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ, সংগঠিত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর। ১৭২৪ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত নিজামরা এই রাজ্য পরিচালনা করেন। তাদের মধ্যে মীর ওসমান আলী খান ১৯১৭ সালে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ফরমান জারি করেছিলেন। তার ফল হিসেবে ১৯১৮ সালে বশিরবাগে নিজাম কলেজের পাশে একটি ভবনে কার্যক্রম শুরু করে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে উর্দু, ফার্সি, আরবি, তেলেগু ও সংস্কৃত সমান মর্যাদা পায় শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে। নারীশিক্ষার প্রসার হায়দ্রাবাদকে অন্য রাজ্যগুলোর চেয়ে অগ্রসর করে তুলেছিল।
আঞ্চলিক রাজ্য হিসেবে তারাই প্রথম স্থাপত্য নির্মাণের ক্ষেত্রে ইসলামি, পারস্য ও দক্ষিণী শিল্পরীতির সংমিশ্রণে গড়ে তুলেছিল অনন্য এক ধারা। তাদের চিরচেনা স্থাপত্যগুলোর মধ্যে গোল গম্বুজ, ইব্রাহিম রওজা, মক্কা মসজিদ, গোলকোণ্ডা ফোর্ট ও গুলবার্গে জামা মসজিদ কিংবা চারমিনারের কথা বলা যেতে পারে। হীরা-মুক্তার ব্যবসা ও টেক্সটাইল শিল্প বিকাশের ফলে অর্থনীতিতেও হায়দ্রাবাদ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। এমনই পরিস্থিতিতে ১৯৪৮ সালে ‘অপারেশন পোলো’র মাধ্যমে নির্মম অভিযানে ভারত হায়দ্রাবাদ দখল করে। তারা তছনছ করেছিল রাজ্যটির স্বাধীনতা, যার ফলাফল- তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটক।
সমৃদ্ধ ইতিহাস প্রমাণ করে, দক্ষিণ ভারতের মানুষের রাজনৈতিক চেতনা, শিক্ষার উৎকর্ষ ও সাংস্কৃতিক বিকাশ তাদের সমাজকে গড়ে তুলেছে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর ভর করে। তাই থ্যালাপ্যাথিরা যখন নতুন কিছুর জন্য লড়াই করেন, সেটির সূচনাবিন্দু থাকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর। ওদিকে অনেকের সাজানো সিংহাসন ভেঙে পড়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্বল নেতৃত্ব এবং ভঙ্গুর প্রশাসনিক অবকাঠামোর কারণে। তাদের পতনে যেখানে রক্ত দেয় সাধারণ মানুষ, অথচ ফল ভোগ করে লুটেরারা।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে সিনেমার রঙ বরাবরই প্রবল। মারুদুর গোপালান রামচন্দ্রন (এমজিআর) থেকে শুরু করে জয়ললিতা- পর্দার জনপ্রিয় মুখগুলোই একদিন হয়ে উঠেছিল রাজনীতির মাঠের বড় খেলোয়াড়। সেই পরম্পরার নবীন সংযোজন জনপ্রিয় চিত্রনায়ক বিজয়। এ বছরই তিনি গড়ে তুলেছেন তামিলগা ভেত্রি কড়গম (টিভিকে)। সম্প্রতি মাদুরাইয়ে অনুষ্ঠিত দলের রাজ্য সম্মেলনে তার বিপুল জনশক্তির প্রদর্শন নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন- শুধু তারকাখ্যাতি ও জনসমাগম কি বিজয়ের দলকে রাজনীতির মূলস্রোতে পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে? নাকি তারা একটা হাইপ তুলে হারিয়ে যাবে?
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
তামিল রাজনীতির সাম্প্রতিক দৃশ্যপটে অখিল ভারত আন্না দ্রাবিড় মুনেত্র কড়গমের (এআইএডিএমকে) ভাঙন ও নতুন শক্তির আবির্ভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত তৈরি করেছে। এই প্রেক্ষাপটেই বিজয়ের আবির্ভাবকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। তার বিপুলসংখ্যক ভক্ত, যারা সিনেমা হলের মধ্যে শোরগোল তুলে সিটি মারার পাশাপাশি রাস্তায় নামতেও দ্বিধা করে না, এরাই সম্মিলিতভাবে তাকে নিঃসন্দেহে এক রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করতে পারে। তবে ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়- শুধু ক্যারিশমাই যথেষ্ট নয়, রাজনীতির ময়দানে টিকে থাকতে গেলে গণমানুষের সমর্থনের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রজ্ঞাটাও জরুরি।
মারুদুর গোপালান রামচন্দ্রনও (এমজিআর) প্রথমে দ্রাবিড় মুনেত্র কড়গম তথা ডিএমকের ছত্রছায়াতেই রাজনীতির পাঠ শিখেছিলেন, আর সেই রাজনৈতিক পরিসর তাকে দিয়েছিল স্থায়ী ভিত্তি। মনে করা হয়, এমজিআরের রাজনৈতিক সাফল্যের পেছনে দুটি স্তম্ভ ছিল- একদিকে নিপুণভাবে নির্মিত সিনেমার নায়ক ইমেজ, অন্যদিকে ডিএমকের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিকাঠামো। এমজিআর ছিলেন পর্দার অবহেলিত নায়ক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চরিত্র। তার এই ইমেজ অবহেলিত জনতার দৈনন্দিন যন্ত্রণার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। সেই ইমেজকে রাজনৈতিক রূপ দিয়েছিল ডিএমকের সমাজ-সংস্কারভিত্তিক ভাষ্য। ফলে এমজিআরের জনপ্রিয়তা কেবল তারকাখ্যাতিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা রূপ নিয়েছিল রাজনৈতিক শক্তিতে।
বিজয়ের যাত্রাপথ কিছুটা ভিন্ন। তার সিনেমায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছাত্র, শিক্ষক কিংবা সেনাসদস্যের চরিত্রে সাধারণ মানুষের মুখপাত্র হওয়ার চেষ্টা দৃশ্যমান। এভাবে তিনি নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির আকাক্সক্ষা ও ক্ষোভকে ধরতে চাইছেন। সম্মেলনে বিজয় যে প্রতীকী রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছেন সেটাও অনন্য। তিনি একই মঞ্চে কোঞ্জিভারাম নেতারাজ আন্নাদুরাই (সিএনএ), মারুদুর গোপালান রামচন্দ্রন (এমজিআর) এবং নিজের প্রতিকৃতি তুলে ধরেছেন। তিনি তার বক্তৃতায় পেরিয়ার, আম্বেদকর, কামারাজ, ভেলু নাচিয়ার প্রমুখকেও স্মরণ করেছেন। বিজয় স্পষ্ট করেছেন যে, ডিএমকের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে অস্বীকার না করে বরং সেটিকে নিজের ছকে সাজাতে চাইছেন।
তবে এখানেই মূল প্রশ্ন- ডিএমকের উত্তরাধিকারকে কি সহজে স্থানচ্যুত করা সম্ভব? প্রায় এক শতাব্দী ধরে আত্মমর্যাদা, ভাষা-গর্ব, জাতিগত সমতার যে রাজনৈতিক ভাষ্য ডিএমকের হাত ধরে তামিলনাড়ুতে বিকশিত হয়েছে, তার ভিত্তি আজও দৃঢ়। পেরিয়ার ও আন্নাদুরাইয়ের উত্তরাধিকার ক্ষীণ হলেও সেই প্রতীক ও স্মারকচর্চা এখনও ডিএমকের সাংস্কৃতিক আধিপত্য বহন করছে। তাই বিজয় যদি সত্যিই বিকল্প শক্তি হতে চান, তাকে শুধু তারকাখ্যাতির ওপর ভরসা রাখলেই চলবে না, একটি সুস্পষ্ট আদর্শগত অবস্থানও তৈরি করতে হবে।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
ডিএমকের দুর্বলতাগুলো সামনে আনা তথা দলিতদের ধারাবাহিক বঞ্চনা, মধ্যবর্তী জাতিগোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং প্রান্তিক শ্রেণির কাছে প্রকৃত ক্ষমতা ও সম্পদের বণ্টনে ঘাটতি নিয়ে বিজয়কে অবশ্যই শক্তিশালী বক্তব্য দিতে হবে। তা না হলে তার দল টিভিকে কিছু আসন জিতলেও ভবিষ্যৎ ইতিহাসে বিজয়ের নাম থাকবে বিজয়কান্তের মতো ক্ষণস্থায়ী উদ্যোগ হিসেবে। তাকে এমজিআরের মতো যুগান্তকারী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে এখনও পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ।
বিজয় যদি প্রচলিত প্রথা ভেঙে নতুন রাজনীতির সূচনা করতে পারেন তবে তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। পদ বণ্টনে জাতিভিত্তিক হিসাবনিকাশ না মেনে যোগ্যতা ও সততার ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন কিংবা সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে নির্ভীক অবস্থান রাখতে পারলে তিনি সত্যিই জনমানসে ভিন্ন এক চিত্র আঁকতে সক্ষম হবেন। তার দলের মূলমন্ত্রও একটু অন্যরকম। তারা বলছে- ‘পিরাপ্পোক্কুম এল্লাআ উড়িক্কুম সিরাপ্পোবাআ ছেইড়োঝিল বেতরুমাই ইয়ান’- অর্থাৎ জন্মসূত্রে সবাই সমান, কর্ম মানুষের সামাজিক অবস্থান ঠিক করে দেয়। তাদের এই দর্শন যদি কেবল স্লোগানে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তব রাজনীতিতেও প্রতিফলিত হয়, তবে তা হতে পারে ডিএমকের আধিপত্যের বিপরীতে এক প্রকৃত বিকল্প।
সাম্প্রতিক তামিল রাজনীতিতে শুধু সভা-সমাবেশ নয়, অনলাইন মাধ্যমে তথা সামাজিক মাধ্যমের লড়াই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিজয়ের তারকাখ্যাতি তাকে এখানে বাড়তি সুবিধা দিতে পারে। তিনি যদি জনগণকে তাদের জন্য কল্যাণমুখী সুস্পষ্ট বার্তা দিয়ে ধারাবাহিক প্রচার এবং সুচিন্তিত মতাদর্শ নিয়ে এগিয়ে যান, তবে ‘তামিল রাজনীতির জমাট বাস্তবতা’য় ডিএমকের বিকল্প হিসেবে টিএমকের উত্থান অসম্ভব কিছু নয়। তবে এই বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে বিজয়কে তার নায়কোচিত ভঙ্গিমায় আটকে না থেকে প্রান্তিক ও বঞ্চিত মানুষের রাজনৈতিক কণ্ঠস্বরে পরিণত হতে হবে। ধর্মীয় উগ্রবাদ আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তার সাম্প্রতিক পদযাত্রা তামিল রাজনীতির নতুন অধ্যায় সূচনার যে বার্তা দিয়েছে, তা ভোটের রাজনীতিতে কতটা সফলতা নিয়ে আসে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
ড. মো. আদনান আরিফ সালিম : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়