শেয়ারবাজার : আস্থা ফিরছে, নাকি সাময়িক উত্থান?

রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী
২৪ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
শেয়ারবাজার : আস্থা ফিরছে, নাকি সাময়িক উত্থান?

বাংলাদেশের শেয়ারবাজার দীর্ঘদিন ধরে অস্থিরতা, অনিয়ম ও বিনিয়োগকারীদের চরম আস্থাহীনতায় ভুগছিল। বহুবার এই বাজারে খুচরা বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সরে গেছেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা যে সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছে, তা বাজারে বেশকিছু ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পেরেছে। দীর্ঘদিনের আস্থাহীনতা, অনিয়ম এবং খুচরা বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির অভিজ্ঞতার পর সংস্কারের পদক্ষেপগুলো বাজারকে খানিকটা স্থিতিশীল করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ডিএসই এক্স সূচকের উত্থান কিংবা লেনদেন বৃদ্ধিকে অনেকেই ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। কিন্তু এখানে মূল প্রশ্নটা করা দরকার- এই উন্নতি কতটা স্থায়ী?

বাংলাদেশের শেয়ারবাজার একাধিকবার বড় ধসের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। প্রতিবারই বিনিয়োগকারীদের, বিশেষ করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের আস্থা ভেঙেছে, বাজারের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ কমেছে। এবার সংস্কারের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে- ডিমিউচুয়ালাইজেশন, তালিকাভুক্তির কঠোর নীতি, আধুনিক ট্রেডিং সিস্টেম, এমনকি বন্ড মার্কেট সক্রিয় করার প্রচেষ্টা, এসব নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। তবে কেবল নিয়ম প্রণয়ন করলেই হবে না, তার সঠিক প্রয়োগই হবে আসল পরীক্ষা। কারণ আগেও বহুবার বহু নিয়ম বানানো হলেও তার প্রয়োগের অভাবে পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী করতে ব?্যর্থ হয়েছে।

বর্তমান নিয়ন্ত্রক সংস্থার কড়াকড়ির কারণে এখন দুর্বল কোম্পানির বাজারে প্রবেশের সুযোগ সীমিত হয়েছে অনেকটাই। ফলে বিনিয়োগকারীরা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে পারবেন বলে আশা করছেন। অনলাইন ও মোবাইল ট্রেডিং বিনিয়োগকে আরও সহজ করছে। এতে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত অনেক বেশি তথ্যনির্ভর হয়ে উঠছে।

আরও একটি ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে বিএসইসি। ২০২৫ সালে বিএসইসি মার্জিন ঋণের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণের নিয়ম করেছে, যা মূলত ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের প্রবণতা কমাবে। কমপক্ষে ৫ লাখ বিনিয়োগ এবং নিয়মিত আয় থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে মার্জিন লোন নেওয়ার জন্য। অর্থাৎ ছাত্র, গৃহিণী, অবসরপ্রাপ্ত যারা নিয়মিত আয় করেন না, তারা মার্জিন ঋণ পাবেন না। মনে হতে পারে এটা তাদের জন?্য বৈষম?্যমূলক। তবে এটি আমার মতে শতভাগ সঠিক। কেননা মার্জিন লোন ঝুঁকির পরিমাণ বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় এবং নিয়মিত আয় না থাকা মানুষদের জন্য অতিরিক্ত ঝুঁকি নেওয়া একদমই অনুচিত।

ঝুঁকি আরও কমানোর লক্ষ্যে ১০ লাখ টাকার নিচে বিনিয়োগকারী হয়ে থাকলে তিনি পোর্টফোলিওর অর্ধেক, ১০ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে হলে পোর্টফোলিওর পূর্ণ মূল্যের ঋণ দেওয়ার নীতি করা হয়েছে। মার্জিন ঋণে বোর্ড সদস্য হওয়ার সুযোগ বন্ধ ও বিভিন্ন ঝুঁকির বিরুদ্ধে স্টক মার্কেটকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই নিয়মগুলো বাজারে অতিমূল্যায়ন বা ঋণের ভিত্তিতে লেনদেনের প্রবণতা কমাবে বলে আশা করা হচ্ছে- বিশেষ করে ২০১০ ও ২০১১-এর মতো অতীতে সংঘটিত মার্জিন কালোবাজারির পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে। বিনিয়োগকারীরা আশাবাদী।

তবে এই নীতির প্রভাব যে বাজারে এখনই দেখা যাচ্ছে তা বলা যাবে না। বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) শীর্ষ ১০ গেইনারের মধ্যে দুটি ছিল জাঙ্ক শেয়ার এবং সাতটি ছিল ‘বি’ ক্যাটাগরির। কোনো কোম্পানি যদি ছয় মাস টানা বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ রাখে, অথবা টানা দুই বছর লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হয়, অথবা নির্ধারিত সময়ে বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) আয়োজন করতে না পারে তবে তাকে জাঙ্ক হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। অথচ এই দুর্বল কোম্পানিগুলোর শেয়ার বর্তমানে একই শিল্প খাতের নিয়মিত ব্যবসায়ী, মুনাফা করা এবং শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ প্রদানকারী কোম্পানির তুলনায় অনেক বেশি হারে বাড়ছে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইনফরমেশন সার্ভিসেস নেটওয়ার্ক- একটি আইটি কোম্পানি। বৃহস্পতিবার এর শেয়ারদর ১০% বেড়ে দিনের সর্বোচ্চ গেইনার হয়। অথচ এ বছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে কোম্পানিটি ১৮.৬ লাখ টাকা লোকসান করেছে এবং ফিসকাল ইয়ার ২৪-এ মাত্র ০.৫০% নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। এ ছাড়া এই কোম্পানির স্পনসর-ডিরেক্টররাও ন্যূনতম ৩০% শেয়ার ধারণে ব্যর্থ হয়েছে; তারা যৌথভাবে মাত্র ২১.৪৭% শেয়ার ধরে রেখেছেন। এত দুর্বল আর্থিক অবস্থার পরও কোম্পানিটির শেয়ার এই সপ্তাহে ৪৭%-এর বেশি বেড়ে বৃহস্পতিবার ৭২.৬ টাকায় বন্ধ হয়েছে।

তাই বাজারের সূচকের মূল্যবৃদ্ধি বা লেনদেনের পরিমাণ বৃদ্ধি দেখেই আমরা এখনকার নেওয়া নতুন নিয়মগুলো যে সফল হয়েছে তা বলতে পারি না। আমাদের দেখতে হবে এই মূল?্যবৃদ্ধি, লেনদেন বৃদ্ধি আসলে কাদের অবদানের জন্য হচ্ছে। এখানে কোনো পক্ষ বিশেষ কোনো সুবিধা নিয়ে, কৃত্রিমভাবে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করার পরিকল্পনা করছে কি না। শুধু লেনদেনের সংখ্যার বিচার না করে গুণগত মানের বিচার করতে হবে আমাদের।

নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে রি-অ্যাকটিভ না হয়ে প্রো-অ্যাকটিভ হতে হবে এবং বাজারে আস্থা ফিরে আসার এ ধারা যেন কোনোভাবে ব?্যাহত না হয় তার দিকে বিশেষ নজরদারি অব?্যাহত রাখতে হবে। বাজারে ক্ষতি-মুনাফা থাকবেই, তবে সেটা যেন কোনোভাবেই বাজার কারসাজির মাধ?্যমে না হয়, এটি নিশ্চিত করতে হবে। তা হলে বাজারের এই সাময়িক উত্থানকে আমরা বাজার স্থিতিশীলতার জন্য কাজে লাগাতে পারব। একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজার ছাড়া বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনীতির স্বপ্ন অবান্তর। তাই পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী আমাদের করতেই হবে। যত দ্রুত হবে এটি ততই মঙ্গল।

রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী : সহযোগী অধ্যাপক, ফিন্যান্স অ্যান্ড ফিনটেক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি