পাথর লুটের খবরে পাথর হওয়ার ফুরসত নেই
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নির্মোহ লেখক, বিশিষ্ট সাহিত্যিক, কবি ও শিক্ষক আফসান চৌধুরী তার ফেসবুকের কাতর জানালা দিয়ে জানতে চেয়েছেন- ‘পাথর লুট কীভাবে লাভজনক? এত ওজনের মাল, নেওয়াই তো কঠিন ও কী করে এটা দিয়ে?’ না কৌতুকের বশে তিনি এই জিজ্ঞাসা রাখেননি। সাফ দিলেই সিরিয়াসলি তিনি এই প্রশ্ন করেছেন। এটা শুধু আফসান ভাইয়ের প্রশ্ন নয়, দেশের তাবৎ সাধারণ মানুষের মনেও এ কথার সানাই বাজছে। সাধারণ মানুষের বুদ্ধির ঘাটতি নেই, কিন্তু তারা চতুর নয়, তাই নতুন ধারাপাত বা বন্দোবস্তের চানক্যিয় ব্যাকরণ তাদের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এরই মধ্যে একজন স্বঘোষিত জুলাই বিজয়ী, ক্ষমতার মসনদপ্রত্যাশী, রাজনীতির হালুয়া-রুটির পাহারাদার বলে দিয়েছেন- ‘পাথর সরানো হালাল কাম, নইলে নদী বন্ধ্যা হয়ে যাবে। বন্যা হবে।’ দেশের নদীবিজ্ঞানী বা প্রকৌশলীরা এ বাণীর বিরুদ্ধে রাও করেননি। তবে আফসান ভাইয়ের জিজ্ঞাসা নিয়ে নেটজীবীরা বসে নেই। কেউ লিখেছেন, ‘কীভাবে লাভ করে- পাথরে মাথা ভেঙেও পাথরের ব্যবসা বুঝতে পারব না। এসব বুঝ মন্ত্রী-মিনিস্টার, এমপি, উপজেলা আর ইউপি চেয়ারম্যানদের। প্রশাসনের এডিসি রেভিনিউ যারা।’ কেউ বলেছেন, ‘বুঝবেন ক্যামনে, আপনি তো কবি। এ দেশের মানুষ পাথর খায়, মাটি খায়, ব্যাংক খায়! সর্বভুক।’ রহস্য ও কৌতুকপছন্দ কেউ কেউ লিখেছেন, ‘লুট করেনি। নদীর পাড়ে ছিল। ফ্রি পাইছে। লেবার ও ট্রাক দিয়ে উঠায়ে বিল্ডারের কাছে বেইচা দিছে। ইন্ডিয়া থাইকা ভাইসা আসা মালের উপর অধিকার আছে তো।’ উত্তর বা ট্রলের বহুমাত্রিক কোণ দেখে বোধকরি কিছুটা হতাশ হয়ে কবি আবার সোজা-সাপটা প্রশ্ন করেছেন- ‘এটি কী কাজে ব্যবহৃত হয়? এবং কেন এটি এত মূল্যবান যে চুরি করতে হবে?’ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে এগিয়ে এসেছেন তার এক দার্শনিক শিক্ষার্থী, তিনি লিখেছেন, ‘স্যার, টাকার ওজনের কাছে পাথরের ওজন কিছুই না।’ একটু বৈষয়িক-কম-দার্শনিক কিসিমের অন্য এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘বাড়ি বানাইতে কাজে লাগে স্যার! হ্যাঁ স্যার! পাথর ভাঙ্গায়ে মিক্সচারে দেয়। এতে নাকি বাড়ি মজবুত হয়।’ একজন স্বভাবত উকিল গোত্রীয় তালেবান (শিক্ষার্থী অর্থে) বাহাসের সুরে লিখেছেন, ‘স্যার, পাথর গেলো, আবার ফিরা আইলো! এতদিন পরে পোস্ট দিলেন?’ আফসান চৌধুরীর সহপাঠী হতে পারেন এমন একজন শেষমেশ পরামর্শ দিয়েছেন, ‘জানতে হলে তোমাকে আরও পড়াশোনা করতে হবে। এটার তফসির হতে পারে মিয়া- তোমার এলেম দিয়ে এসবের কূলকিনারা পাবে না। গভীরে যেতে হলে আরও গম্ভীর এলেমচর্চায় শামিল হতে হবে।’
পাথরের হাল সাকিন
ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশে ধলাই নদীর উৎসমুখের অংশটিই মূলত সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এই সাদাপাথর এলাকার পাশেই সিলেট শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে ভোলাগঞ্জ পাথরকোয়ারি। কোয়ারি মানে বলা যায়, খোলা খনি। এখানে প্রাকৃতিকভাবেই পাথরের মজুদ গড়ে উঠেছে। প্রধানত চুনাপাথর ও জীবাশ্মযুক্ত ঝিনুক দিয়ে গঠিত এই পাথরগুলো লাখ লাখ বছর ধরে নদীর স্রোতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মসৃণ হয়েছে। পাথরের জন্য বিখ্যাত সিলেটের জাফলং একসময় ছিল খাসিয়া-জৈন্তিয়া রাজার অধীনে নির্জন বনভূমি। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর ১৯৫৪ সাল থেকে পতিত ছিল বিস্তীর্ণ এলাকা। ধীরে ধীরে ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌপথে জাফলং আসতে শুরু করেন। পাথর ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকলে সেখানে গড়ে ওঠে জনবসতি। পাকিস্তানের সময় ষাটের দশকে বড় বড় নির্মাণকাজ শুরু হলে সীমান্তঘেঁষা সিলেটের বিভিন্ন নদী মোহনায় পাথরের সন্ধান শুরু করেন ব্যবসায়ীরা। পাকিস্তানিরা চলে যাওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশে কোয়ারিগুলো ইজারা দেওয়া শুরু হয়। আশি ও নব্বইয়ের দশকে শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে সিলেটের ‘পাথররাজ্য’।
পাথররাজ্যের শাসক কে? ‘এরা কারা? কোথা থেকে এলো?’
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
সিলেটের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাথর উত্তোলনের কাজ করেন বারকি শ্রমিকরা। কাজের সন্ধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা খেটে খাওয়া মানুষ ‘বারকি’ নামের এক ধরনের লম্বা কাঠের নৌকায় করে বালু ও পাথর পরিবহনের কাজ করেন। এই শ্রমিকদের বারকি শ্রমিক বলা হয়। আগে তারা নদী থেকে বালু-পাথর তুলে আশপাশের এলাকায় মজুদ করে রাখেন। সেখান থেকে কিনে নিতেন ব্যবসায়ীরা। ১৯৯১-এর পর ধীরে ধীরে পাথর ব্যবসা পাথর মাফিয়াদের হাতে চলে যায়। গজিয়ে ওঠে নানা রঙের আর উচ্চতার ‘স্টোন লর্ড’। মদদ ও আশ্রয় আসে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে। এদের রাজনৈতিক নেতা না বলে লাঠিয়াল বলাই ভালো। তবে এটাও ঠিক, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পদ-পদবি দিয়ে হাতে রাখে। হাতখরচ চালাতেই নাকি হাতে রাখতে হয়। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) আইন-আদালত করার পর গত সরকারের সময় কাগজে-কলমে পাথর তোলা বন্ধ থাকলেও একটি মহল সে সময় পাথর তুলে বেচাবিক্রি করত কোনো রাখঢাক ছাড়াই। পাথর তোলা বন্ধের পদক্ষেপ নিলেই তাদের সমর্থিত লোকজনকে মাঠে নামানো হয় পাথর উত্তোলনের দাবিতে বারকি শ্রমিকদের সামনে রেখে। গত বছরের ৫ আগস্ট একদল মানুষ যখন সাবেক গণভবনসহ সংসদ ভবন ও নানা স্থাপনায় লুটপাট চালাচ্ছিল, তখন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সিলেটের সব কোয়ারির নিয়ন্ত্রণ নেন বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতারা। অভিযোগ রয়েছে, তাদের মদদেই প্রকাশ্যে পাথর লুট শুরু হয়। এ সময় গোয়াইনঘাটের জাফলং, বিছনাকান্দি; কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথরকোয়ারি, শাহ আরেফিন টিলা, সংরক্ষিত বাংকার (রেলওয়ের পুরনো স্থাপনা) এলাকা ও উৎমাছড়া এবং কানাইঘাটের লোভাছড়ার পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন শুরু হয়। এক বছর ধরে লুটপাটের কারণে এসব এলাকা এখন অনেকটাই পাথরহীন। অন্য সব জায়গায় পাথর বেশির ভাগ লুট করার পর নজর পড়ে পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথর এলাকায়। গত ২৩ এপ্রিল থেকে সেখানে লুটপাট শুরু হয়। তবে সেখানে বেশি লুটপাট হয়েছে বিগত এক মাসে।
শুধু কি পাথরমহাল, নয়া কোয়ারি লুট হয়?
না, নদীর পাথরের পাশাপাশি টিলার পাথরও হরদম লুটপাট হয়, হচ্ছে। কোম্পানীগঞ্জ থানার শাহ আরেফিন টিলা এখন কঙ্কাল হয়ে পড়ে থাকার পরও লুটেরারা ছাড়েনি। প্রায় ১৩৭ একর জমির শাহ আরেফিন টিলাসহ আরও একাধিক স্পটে চলে পাথর লুট। আওয়ামী লীগের আমলে কথিত ‘পাথর লর্ড’ হিসেবে মানুষ ভয় পেত শামিম বাহিনীকে। এই বাহিনী এতই শক্তিশালী ছিল যে, কেউ নিউজ করা দূরে থাক, শাহ আরেফিন টিলার আশপাশে ঢুকতে পারেননি কোনো সাংবাদিক। একবার এক টেলিভিশনের গাড়ি ভেঙে সাংবাদিকদের প্রচণ্ড মারধর কারা হয়েছিল। টেলিভিশনের সে গাড়িতে থাকা নারী সাংবাদিকরাও সহিংসতার শিকার হন। থানা মামলা নেওয়ারও সাহস পায়নি। গেল এক বছরে মিলেমিশে অন্তত আরও ৯টি আলাদা গ্রুপের নেতৃত্বে মাটি খুঁড়ে লুট হয় কোটি কোটি ঘনফুট পাথর। টিলা এলাকার ধ্বংসস্তূপে এখন কারও দেখা না মিললেও কিছু মেশিন পড়ে আছে, বাকিগুলো অভিযানের ভয়ে সরিয়ে নিয়েছে চক্রের সদস্যরা, তবে দূর থেকে জায়গাটিতে নজরদারি রেখেছে। এখনও এলাকাজুড়ে স্তূপ করে রাখা আছে অবৈধ উপায়ে উত্তোলন করা পাথর। গত বুধবার (২০ আগস্ট) কোম্পানীগঞ্জ পরিদর্শনে গিয়ে লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা উন নবী।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
‘পাথর সরানো’ কি হালাল কাম?
পরিবেশবিদরা বলছেন, যে যাই বলুক না কেন প্রাকৃতিকভাবে তৈরি কোয়ারিগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। স্বচ্ছ পানির এই আধার স্থানীয় খাবার পানিরও উৎস। পাহাড়ি ঢলের তোড় (পানিপ্রবাহের তীব্রতা) সামালাতেও এসব পাথরের বড় ভূমিকা আছে। মজার ব্যাপার, যেখানে তোড় বেশি সেখানে পাথর জমে বেশি। এটাই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার স্বয়ংক্রিয় প্রচেষ্টা, আল্লাহর কুদরত। পাথরের কাজ হচ্ছে ওই তোড়ের পানিটাকে ভেঙে ভেঙে টুকরো টুকরো করে তার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। শুধু কি তাই? পানির মধ্যে অক্সিজেন সংশ্লেষ করাও এর কাজ, যাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় ‘সোলার অ্যাকুয়াটিক ন্যাচারাল প্রসেস অব ট্রিটমেন্ট’ বলা হয়। প্রকৃতির এই ব্যবস্থাপনার কোথাও যদি ব্যাঘাত ঘটানো হয় অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে যদি পাথর সরিয়ে ফেলা হয়, তবে স্রষ্টার সৃষ্টির গাড়িটাই লাইনচ্যুত হবে, ভেঙে পড়বে তার শৃঙ্খলা। অনিয়ন্ত্রিত পানির তোড়ে দুই পাশে প্লাবনের পরিমাণ বাড়ে যাবে, বাড়বে ভাঙন। সিলেটের ২০১৭ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় আমরা দেখেছি ঢলের পানি কী সাংঘাতিকভাবে দূষিত হতে পারে। হাওরে মাছের মড়ক লেগে গিয়েছিল সে বছর। ভুলে গেলে চলবে না, এ অঞ্চলের অনেক জায়গায় খাবার পানির স্বল্পতা মেটায় এই পাহাড়ি পানি।
শুধু সাধারণ নির্মাণকাজ নয়, সিলেটের এই পাথরের শৌখিন চাহিদাও বাড়ছে দিন দিন। ধনীদের নজর থেকে সুন্দরী এসব পাথর বাঁচানো মুশকিল, যেমন মুশকিল প্রবাল বাঁচানো। আগেও শত শত বছর ধরে এখানকার পাথর মন্দির, প্রাসাদ ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে। স্থানীয় কারিগররা এই পাথর দিয়ে সূক্ষ্ম নকশা ও ভাস্কর্য তৈরি করেন, যা পর্যটকদের কাছে স্মারক হিসেবে বিক্রি হতো। এখন বাগানবাড়ির আর রিসোর্টের হাঁটার পথ তৈরিতে এস্তেমাল হচ্ছে এসব পাথরের। বাড়ির দেয়ালে বাড়তি আভিজাত্য আনতে আনা হচ্ছে হাওরের রক্ষাকবচ এসব পাথর। হাঁটা পা মূলত শৌখিন সাজসজ্জা ও নির্মাণকাজে ব্যবহার করা হয় সাদাপাথর এলাকার পাথর। পাথর উত্তোলনের ফলে পরিবেশ ও পর্যটন এলাকার নান্দনিকতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধুই কি নান্দনিকতা? এসব পাথর না থাকলে হাওর থাকবে কি? এটা যে ইকোলজি ধ্বংসের আয়োজন সেটা যারা বুঝতে নাচার তাদের নাচ আর কতদিন দেখতে হবে?
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
ড. গওহার নঈম ওয়ারা : লেখক ও গবেষক