একজন পড়ে গেলে, দশজন দাঁড়িয়েছে

অনলাইন ডেস্ক
২১ আগস্ট ২০২৫, ২৩:৫২
শেয়ার :
একজন পড়ে গেলে, দশজন দাঁড়িয়েছে

২০২৪ সালের জুলাই—বাংলাদেশের ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অথচ গৌরবময় অধ্যায়। এটি কেবল একটি আন্দোলন ছিল না, বরং এক জাতির বিবেক জাগরণের মুহূর্ত।

১৬ জুলাই ২০২৪, রংপুর শহর—ছাত্রনেতা আবু সাঈদ বুক চিতিয়ে পুলিশের সামনে দাঁড়ালেন। তিনি জানতেন এর পরিণতি মৃত্যু হতে পারে; তবুও পিছিয়ে যাননি। মুহূর্তেই পুলিশের গুলিতে তিনি লুটিয়ে পড়লেন। সেই মুহূর্ত থেকে আন্দোলনের চরিত্র বদলে যায়—এটি আর কেবল কোটা সংস্কারের দাবি নয়, হয়ে দাঁড়ায় স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও মানুষের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের লড়াই।

গুলির শব্দ, ধোঁয়া, রক্তের গন্ধ উপেক্ষা করে মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। একজন পড়ে গেলে, দশজন এগিয়ে আসত। তারা ছাত্র, শ্রমিক, রিকশাচালক কিংবা কোনো অচেনা পথচারী—কিন্তু সাহসের মাপে তারা সমান। ইতিহাস তাদের কথা লিখেছে এক বাক্যে—‘মেরেছে একজন, দাঁড়িয়েছে দশজন।’

জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থার তথ্যে দেখা যায়, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে নিহত হয়েছে ৬০০ থেকে ১,৪০০ মানুষ। জাত্রাবাড়ি গণহত্যায় এক দিনে ৫২ জন নিহত, চাঁখারপুলে দিনের আলোয় হত্যা, আশুলিয়ায় জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারা—এসব ছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নগ্ন রূপ। কিন্তু আজ সেই মানুষগুলো কোথায়? অনেক পরিবার এখনও ন্যায়বিচার পায়নি, অনেকে চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে। অথচ আমরা সামাজিক মাধ্যমে অন্য খবরে ব্যস্ত। আমরা কি ভুলে গেছি—তারা আমাদের জন্য দাঁড়িয়েছিল?

যারা দাঁড়িয়েছিল, যারা মৃত্যুকে চোখে চোখ রেখে উপেক্ষা করেছিল—তাদের হাতেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা তুলে দেওয়া উচিত। তারা ছাত্র হোক, কৃষক হোক বা অচেনা মানুষ—সাহসে তারা সমান মর্যাদার।

আমার আশপাশের গ্রাম একসময় জন্ম দিয়েছে ধর্মপ্রাণ নেতা ও সমাজসেবক। কিন্তু সময়ের প্রবাহে সেখানেই তৈরি হয়েছে ভয় ও পেশিশক্তির রাজনীতি। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর পর সেই শক্তিই দেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের উত্থান যেন শুকনো ঘাসে আগুন—শুরু হয় ছোট জায়গা থেকে, কিন্তু গ্রাস করে পুরো দেশকে।

তবুও মনে রাখতে হবে—গণঅভ্যুত্থানে যারা দাঁড়িয়েছিল, তারা কেবল পুলিশের গুলির সামনে নয়, আমাদের ভবিষ্যতের জন্য দাঁড়িয়েছিল। আমরা যদি তাদের ভুলে যাই, তবে আমাদেরও একদিন কেউ মনে রাখবে না।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫৫ বছর পরও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহিরাগত প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ভারতের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা, রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তাদের আশীর্বাদ কামনা, আর জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি উদাসীনতা—আজকের প্রজন্মের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

১৯৭১ সালে ভারতের সহযোগিতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু স্বাধীনতার পর আমাদের আসল প্রশ্ন ছিল—আমরা কি নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় স্বাধীন? বন্ধুত্ব মানে অনুগত হওয়া নয়; স্বাধীনতা মানে স্ব-নির্ধারণের ক্ষমতা।

২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভারতের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক প্রমাণ করেছে—জনগণ চায় বিদেশি প্রভাবমুক্ত রাজনীতি। ‘দেশটা কারো বাপের নয়’—এই স্লোগান জনগণের গভীর স্বাধীনচেতা দাবি তুলে ধরে। বিদেশি হস্তক্ষেপের বদলে রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব হবে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা।

গণতন্ত্র টিকে থাকে জনগণের আস্থায়। অথচ অনেক সময় রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থে বিদেশি সমর্থন খোঁজে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর নাম ব্যবহার করে ভয় সৃষ্টি করা কিংবা বিরোধীদের দমন করা জাতীয় সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও জ্বালানি খাতে ভারতের প্রভাব রয়েছে, কিন্তু একপাক্ষিক নির্ভরতা বিপজ্জনক। তাই চীন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বহুমুখী সম্পর্ক গড়ে তোলা জরুরি। সীমান্ত, পানি, বাণিজ্য ও নিরাপত্তা—সবক্ষেত্রে দরকার সুষম ও স্বাতন্ত্র্যমূলক কূটনীতি।

স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র পূর্ণ হয় না। আজকের বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত; রাজনৈতিক চাপের কারণে প্রকৃত সংবাদ ব্যাহত হয়। জনগণকে সঠিক তথ্য দেওয়ার জন্য গণমাধ্যমকে মুক্ত করতে হবে। একই সঙ্গে রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য।

রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে জনগণ ও দেশের সার্বভৌমত্ব। বিদেশি প্রভাব নয়, জনগণের আস্থা ও কল্যাণই হবে রাজনীতির ভিত্তি। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে দায়িত্বশীল অঙ্গীকারের ওপর।

আমরা বলি—দেশটা ভারতের নয়, দেশটা আমাদের।

এই মন্ত্রকে শুধু উচ্চারণ নয়, বাস্তবায়নে রূপান্তর করতে হবে। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ, স্বাধীন ও সাহসী রাজনীতিই পারে বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী ও গর্বিত জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে।

রহমান মৃধা

গবেষক ও লেখক

(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)