আপনার ধূমপানের শিকার কেন আমি হবো?
রাজধানীর গণপরিবহনগুলোতে ধূমপান একটি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি চলাকালে চালক ও তার সহকারীর প্রকাশ্যে ধূমপান একটি ভয়াবহ দৈনন্দিন সমস্যা, যা ধূমপায়ীর পাশাপাশি অন্যদেরকেও ক্ষতি করে। গণপরিবহনে আইনত ধূমপান নিষিদ্ধ হলেও তা প্রতিনিয়তই লঙ্ঘন হতে দেখা যায়। এই পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী নারীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
গণপরিবহনে চালক ও তার সহকারীদের মধ্যে প্রকাশ্যে ধূমপানের প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। এতে আমরা যাত্রীরা ভীষণ বিরক্তি ও অস্বস্তি বোধ করি। তারা যাত্রীদের বারণ সত্ত্বেও ঘুম আসা, মাথা ব্যাথাসহ নানান অজুহাত দেখায় এমনকি এটা নিয়ে কখনও কখনও মানুষের সাথে খারাপ আচরণও করে থাকে। অথচ বাসের সকল যাত্রীরা যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সে বিষয়ে তাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। তারা গাড়ীতে ধূমপান করবেই ব্যাস! ধূমপান করতে নিষেধ করলেই চালকরা যাত্রীদেরকে বলে থাকে অন্য গাড়িতে যান। ড্রাইভারদের এ ধরণের কথা শোনার পরও আমাদেরকে ওই বাসেই চলাফেরা করতে হয়। তখন আসলে নিজেদের অনেক অসহায় মনে হয়। অতি দু:খেই বলতে হয় - কি একটা দেশে আমরা বাস করি আইনের কথা বলেও থামানো যাচ্ছে না ড্রাইভার ও তার সহকারীর ধূমপান। আইনে আছে, পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে কোন ব্যক্তি ধূমপান করলে ৩০০ টাকা জরিমানা এবং দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে জরিমানা দ্বিগুণ হারে আদায় করা হবে। আমরা এই আইনের সঠিক বাস্তবায়ন চাই। কারণ তামাক একটি নীরব ঘাতক যা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। জ্বলন্ত সিগারেট-বিড়ি থেকে নি:সৃত ধোঁয়ায় ধূমপায়ীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষও ক্যান্সার, হার্ট এ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার ও ফুসফুসের বিভিন্ন ধরণের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে বাংলাদেশে বছরে ১ লক্ষ ৬১ হাজারের অধিক মানুষ অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। প্রতিবছর তামাকের কারণে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে ক্ষতি হচ্ছে ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। তামাকজনিত কারণে রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করাতে গিয়ে এক একটি পরিবারকে হতে হয় একেবারে নি:স্ব। কাজেই তামাকের ভয়াবহতা থেকে রক্ষায় এর বিরুদ্ধে সকলকে রুখে দাঁড়াতে হবে। নইলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অকালেই ঝরে পড়বে। কেননা তামাক কোম্পানিগুলো সাধারণত তরুণদেরকে টার্গেট করে থাকে। তরুণদের হাতে তামাক ধরিয়ে দিতে পারলেই তারা দীর্ঘমেয়াদী ভোক্তা পেয়ে যায়। রাস্তায় বের হলেই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদেরকে ধূমপান করতে দেখা যায় যা খুবই উদ্বেগের বিষয়। অথচ অভিভাবকরা জানেনও না তাদের সন্তান এই বয়সে ধূমপানে আসক্ত হয়ে গেছে যা তাদরেকে অন্যান্য নেশার দিকে ধাবিত করছে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
বাংলাদেশে সকল সমস্যা সমাধানে সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও বাস্তবায়নের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গণপরিবহনে এবং পাবলিক প্লেসে ধূমপান আইনে নিষিদ্ধ থাকলেও আইন মানা হচ্ছে না। বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সঠিক বাস্তবায়নে মনিটরিং জোরদার করা এবং সে অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে গণপরিবহনকে ধূমপানমুক্ত করা সম্ভব। চালকদেরকে বাসে ধূমপান নিষিদ্ধের আইন সম্বন্ধে বলা হলে উত্তরে তারা বলে, আইন শুধু বইয়েই লেখা থাকে কেউ এগুলো মানে না। যা বাস্তবায়নের দূর্বলতাই স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়। আমরা যারা গণপরিবহনে নিয়মিত যাতায়াত করি তাদেরকে এই সমস্যাগুলো সাথে নিয়েই চলতে হয়। আর এ কারণে সবাই অসুস্থ হবে এটা মেনে নেয়া যায় না। একজন ধূমপায়ীর কারণে অন্য দশজন ক্ষতিগ্রস্ত হবে এটাতো মেনে নেয়া যায়না। একজন মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করার অধিকার অন্য কারো নেই। এই অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে মানুষ বাঁচতে চায়। কাজেই গণপরিবহনে ধূমপান বন্ধ করতে হলে আমাদের দেশে যে আইনটি রয়েছে তার কঠোর বাস্তবায়ন ও ধূমপায়ীদের জরিমানসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা উচিত। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হলে অন্য ধূমপায়ীরা এটা দেখে একবার হলেও চিন্তা করবে যে, বাসে বা পাবলিক প্লেসে ধূমপান করা যাবে না। আইন অনুযায়ী প্রতিটা বাসে নিয়মিত মনিটরিং করা এবং চালকদের ধূমপান করতে দেখলে সাথে সাথে অভিযোগ দায়ের এবং তার প্রেক্ষিতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে অবশ্যই গণপরিবহনে চালক ও হেল্পারদের ধূমপান বন্ধ হবে।
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এ বিষয়ে সংবিধিবদ্ধ সতর্কতা থাকলেও মানুষের মধ্যে এখনও সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যদিও জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে দেশে বিভিন্ন সময়ে ধূমপান রোধে নেওয়া হয়েছে নানা ধরণের পদক্ষেপ। আইনের পাশাপাশি রয়েছে জরিমানার বিধানও। কিন্তু সঠিক প্রয়োগের অভাবে মানুষের মধ্যে নেই বিন্দুমাত্র সচেতনতা। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে আইন সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, তামাকজাত দ্রব্যের সহজলভ্যতা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব। গণপরিবহণগুলোতে “ধূমপানমুক্ত এলাকা” বিষয়ক সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে এবং পরিবহন শ্রমিকদেরকে ধূমপান পরিহারে উৎসাহিত করতে হবে। এছাড়া, প্রতিটি বাস ও লঞ্চ টার্মিনালসহ সকল পাবলিক প্লেসে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোর পাশাপাশি শাস্তি ও জরিমানার বিষয়টিও প্রচার করা জরুরি।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
গণপরিবহনে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে বাস টার্মিনালগুলোতে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা জরুরি। ট্রাফিক পুলিশদেরকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে কাজে লাগাতে হবে। গণপরিবহনে নো- স্মোকিং সাইন স্থাপনের পাশাপাশি ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের শর্তসমূহের মধ্যে ধূমপান নিরুৎসাহিতকরণের বিষয়টি সম্পৃক্ত করা জরুরি। সর্বোপরি গণপরিবহনকে শতভাগ ধূমপানম্ক্তু করা তথা পরোক্ষ ধূমপান থেকে সাধারণ জনগণকে রক্ষার্থে চালক, হেল্পার ও যাত্রী সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি। এছাড়াও আগামী প্রজন্মকে ছোট থেকেই তামাকের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত ও সাবধান করতে তামাকের ক্ষতিকর বিষয়গুলো জাতীয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। টার্মিনালগুলোতে ধূমপান নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশন, ইজাদার, বাস-মালিক কর্তৃপক্ষ, শ্রমিক ইউনিয়ন সকলকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাপক জনসচেতনতা ছাড়াও পরিবহন সংস্থাসহ বিআরটিএ, বিআরটিসি, বিআইডব্লিউটিএ এবং পুলিশ বিভাগকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সঠিক বাস্তবায়নে তদারকি জোরদার করাসহ যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে গণপরিবহনকে ধূমপানমুক্ত করা যাবে বলে আমরা আশা করি।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!