অনুপ্রবেশ : প্রচার বনাম বাস্তবতা

মোহাম্মদ সাদউদ্দিন
২০ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
অনুপ্রবেশ : প্রচার বনাম বাস্তবতা

কলকাতার রবীন্দ্রসদন এলাকার আকাদেমি অব ফাইন আর্টসের কনফারেন্স রুমে ‘অনুপ্রবেশ ও বাস্তব ভিত্তি’ শীর্ষক একটি সেমিনার হয়েছিল ২০০৩ সালের মার্চ মাসে। কলকাতার এক সাপ্তাহিক পত্রিকা এই সেমিনারের আয়োজক। সেখানে তখনকার শাসকদল সিপিআই (এম), প্রধান বিরোধী দল তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস থেকে শুরু করে ছোট-বড়-মাঝারি সব দলের প্রতিনিধিই ছিলেন। কিন্তু ওই সেমিনারে দু-একজন বক্তার বেশ কিছু পয়েন্টভিত্তিক বক্তব্য দারুণভাবে শ্রোতাদের আকর্ষণ করেছিল। এমনকি প্রভাবিতও করেছিল। এদের মধ্যে একজন হলেন এককালের হুমায়ুন কবীর ও আতাউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীদের ম্যাগাজিন ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট আব্দুর রাউফ, অন্যজন হলেন আসামের অ্যাডভোকেট জেনারেল আবুল হোসেন মজুমদার। দুজনেই আজ পরপারে। আব্দুর রাউফ সেদিন বলেছিলেন, ‘ভাই ভাইকে এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়ে না। তাহলে এই অবৈধ বাংলাদেশিকে আমরা এমনি এমনি জায়গা দেব?’

অন্যদিকে আসাম রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল আবুল হোসেন বলেছিলেন, “ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে (এখন সেভেন সিস্টার্স হিসেবে খুব জনপ্রিয়) এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যেতে হলে ‘ইনার পারমিট’ লাগে। তাহলে অনুপ্রবেশ হয় কীভাবে? দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীগুলো কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়?”

ওই বছর কলকাতার বিখ্যাত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের কলেজ অডিটরিয়ামে ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেতা (পরে ভারতের রাষ্ট্রপতি) প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘কম অর্থনৈতিক দেশের মানুষ কাছাকাছি বেশি অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশে ধাবিত হন অর্থনৈতিক কারণেই। কিন্তু এখন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্রমশ এগোচ্ছে। কেন, পাশে নেপাল-ভুটান থেকেও তো আমাদের দেশে লোক আসছে ঢালাও হারে।’ দুর্ভাগ্যের বিষয় এটাই যে, সেই প্রণব মুখোপাধ্যায় পরে আরএসএসের সভায় গিয়ে ঢালাও প্রশংসা করলেন ওই উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনটির। আর নরেন্দ্র মোদিজিকে ঢালাও ‘গুড সার্টিফিকেট’ দিলেন। দেশভাগের বহু আগে ও পরে আসা দার্জিলিংয়ের গোর্খা নেপালিদের জন্য একসময় বামফ্রন্ট সরকারকে পৃথক পার্বত্য পরিষদ করতে হয়েছিল। সুভাস ঘিসিংয়ের জিএন?এফ ভেঙে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা হলো বিমল গুরুঙের নেতৃত্বে। এরা পৃথক গোর্খাল্যান্ড থেকে এক ইঞ্চিও সরেনি, তৃণমূল সুপ্রিমো মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পৃথক গোর্খা টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা জিটিএ করার পরও। এমনকি তাদের দাবি প্রথমে গোর্খাল্যান্ড রাজ্য। তারপর তাদের দাবি গোর্খাল্যান্ড রাষ্ট্র। আর গ্রেটার কোচবিহারবাসীরা পৃথক কোচবিহার চাইছে। জলপাইগুড়িসহ কামতাপুরীরা এখনও পৃথক কামতাপুরী রাজ্য চাইছে। পশ্চিমবঙ্গে বহু বিচ্ছিন্নতাদী সংগঠন এখন খুব সক্রিয়। এ নিয়ে বিজেপির মুখে কুলুপ। সব যেন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীতে পশ্চিমবঙ্গ ছেয়ে গেছে!

আমাদের মনে রাখতে হবে, হিন্দু মহাসভা থেকে জনসঙ্ঘ, তারপর আজকের বিজেপি হলো আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা। ১৯৮৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ২টি আসন। হিন্দুত্ববাদ ও সাম্প্রদায়িক অনুপ্রবেশের ধুয়া তুলে সেই বিজেপি ১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৮৮টি আসন পেল। তারপর নব্বইয়ের দশকে রামমন্দির ধুয়া তুলে ১৯৯৯-২০০৪ সালে অটলবিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় এলো। কিন্তু সেই সরকার ছিল অনেকটাই সংখ্যালঘু। আর মোদিকে প্রজেক্ট করে ২০১৪ থেকে তিন-তিনবার বিজেপি ক্ষমতাসীন। বাবরি মসজিদের স্থলে প্রহসনের বিচার করে রামমন্দির তৈরি হলো। আর এখনও অনুপ্রবেশ তাদের মাথায় খেলে শুধু নয়, ভূতের মতো চেপে বসে রয়েছে। আরএসএস তার অঙ্গসংগঠনের সংখ্যা বাড়িয়ে তাদের দিয়ে বাংলাদেশ অনুপ্রবেশকারী তত্ত্বের প্রচারটা ব্যাপক করছে। গোয়েবলসের থিওরির মতোই বারবার বলে অনুপ্রবেশকে সত্যে পরিণত করার চেষ্টা করছে। আর এই অনুপ্রবেশের ধুয়া তুলে বিজেপি-শাসিত ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বাইরের রাজ্যে বাঙালি শ্রমিক বা বাংলাভাষীদের অনুপ্রবেশকারী সাজিয়ে ব্যাপক হেনস্তা ও নির্যাতন করছে। বাংলাদেশি তকমা লাগিয়ে পুশইন করে হয়রানি করছে। খুনের ঘটনাও ঘটছে। বাংলাভাষীদের ওপর নেমে এসেছে এক বিশাল অভিশাপ। এ এক ভয়ংকর বিপজ্জনক পরিস্থিতি। নিজ ভূমিতে পরবাসীর মতো অবস্থা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আসামের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বশর্মা তো বাংলাভাষী হলেই তাকে পুরো বিদেশি বলে উল্লেখ করছেন। এর শিকার যেমন হচ্ছেন আসামের বাঙালিরা, তেমনি শিকার হচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, দুই দিনাজপুর, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, বীরভূম, পূর্ব বর্ধমানের বাংলাভাষীরা। এমনিতেই সিএএর এবং এনআরসির কোপে পড়ে আসামের ৪০ লাখ বাঙালি আজ ডিটেনশন ক্যাম্পে। এদের মধ্যেই ৩৮ লাখ হিন্দু বাঙালি।

পশ্চিমবঙ্গের বাইরের রাজ্য উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরাখ-, বিহার, ঝাড়খ-, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, আসাম, মেঘালয়, দক্ষিণ ভারতের কেরালা, কর্ণাটক, তামিনলাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশে বিশালসংখ্যক বাংলাভাষী শ্রমিক নানা পেশায় কাজ করেন। এদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম থাকলেও মুসলিমের সংখ্যা বেশি। কৃষিকাজ থেকে জরি, পাঞ্জাবির ফুল, রেডিমেড বস্ত্র, রাজমিস্ত্রিসহ এই বাংলাভাষী বা বাঙালি শ্রমিকরা ওই রাজ্যগুলোতে কাজ করেন। এদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী সাজিয়ে পুশইন করাই হলো মোদি সরকারের প্রধান লক্ষ্য। অথচ এদের দশ পুরুষ এই পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেই জন্ম। এই পশ্চিমবঙ্গের মাটিতেই লালিত-পালিত। এ বছরের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বিহারের বিধানসভা নির্বাচন। ২০২৬ সালের এপ্রিল-মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। বিহারের শ্রমজীবী ও বাঙালি শ্রমিকরা এবার ভোটাধিকার হারাবেন স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর-এর যূপকাষ্ঠে বলি হয়ে। অন্যদিকে এইআইএসআর এ বছরের আগস্টে পশ্চিমবঙ্গেও চালু হয়ে গেছে। সাত পুরুষ ধরে বসবাসকারী বাঙালি বা বাংলাভাষীরাও ভোটারহীন হবেন। সব মিলিয়ে ভারতের বাংলাভাষীরা একরকম বিপন্নতার মধ্যেই। অনুপ্রবেশকারী তকমা একদিকে, অন্যদিকে এনআরসি, সিএএ, এনআরপি এবং সাম্প্রতিক এসআইআরে বলি হয়ে বাঙালিরা গভীর সংকটে। কিন্তু সত্যিই কি অনুপ্রবেশ ঘটছে? ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা বিএসএফের জুরিসডিকশন বেড়েছে সীমান্ত থেকে আরও ৫০ কিলোমিটার ভেতরে। তাহলে অনুপ্রবেশ হয় কী করে। আরও একটি কথা হলো, বাংলাদেশে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে তাদের জিডিপি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেড়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তারা বেশ এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের একজন রিকশাওয়ালার দৈনিক আয় তিন হাজার টাকা গড়ে। তাদের দেশ গার্মেন্টস বা বেশ কিছু সেক্টরে দারুণভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলোতে তারা পেশাজীবী হিসেবে কাজ করছেন। তাহলে কেন তারা ভারতে আসবেন? এটাই হলো প্রধান বাস্তবতা।

আজ যখন বিজেপি বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের কথা বলছে, তখন কেন বলা হচ্ছে না, পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ জেলায় ১৯৪৭-এর আগে মুসলিম ছিল ৮১ শতাংশ, আজ তা কমে ৬৬ শতাংশ, মালদহ জেলায় মুসলিম ছিল ১৯৪৭ সালে ৬২ শতাংশ, এখন তা কমে ৫১ শতাংশ, উত্তর দিনাজপুরে ছিল ৬০ শতাংশ মুসলিম, এখন কমে ৪৯ শতাংশ, বীরভূমে মুসলিম ছিল ৪২ শতাংশ, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তা কমে হয় ৩২ শতাংশ। তাহলে বাকি মুসলিমরা গেল কোথায়? পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ সীমান্তবর্তী জেলার মুসলিমরা দেশ ছেড়েছে। কলকাতার মুসলিম উজাড় হয়ে গেছে। ১৯৪৭-৬৪ সাল পর্যন্ত একের পর এক দাঙ্গা পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের বিপন্ন করেছে। তাই তারা দেশ ছেড়েছে। বিশেষ করে ১৯৬৪ সালের দাঙ্গা অনেক হিসাব পাল্টে দিয়েছে। অন্নদাশঙ্কর রায় ছিলেন মুর্শিদাবাদের ডিএম। তাকে বলা হয়েছিল, ওই জেলার মুসলিমদের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু তিনি রাজি হননি। এর জন্য অন্নদাশঙ্করকে অনেক নাকানি-চুবানি খেতে হয়েছিল। সে এক ইতিহাস।

১৯৭১ সালে এই বিপন্নতা পূর্ব পাকিস্তানের বা অধুনা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে ছিল। তারাও দেশ ছেড়েছে খান বাহিনীর রাইফেলের হাত থেকে রেহাই পেতে। কিন্তু বাঙালি হিন্দুদের নৌকায় তুলে দিয়ে ওই দেশের প্রতিবেশী বাঙালি মুসলিম কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছে। আক্ষেপ করে বলেছে, আমরা আমাদের প্রতিবেশীকে ধরে রাখতে পারছি না। তবে বাংলাদেশ তাদের ফিরিয়ে নিয়েছিল একাত্তরের বিজয়ের পর।


মোহাম্মদ সাদউদ্দিন : কলকাতার প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও কবি