রাজনৈতিক বিকৃতি ও জিঘাংসার অনিবার্য উত্তরাধিকার

আদনান আরিফ সালিম
১৯ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
রাজনৈতিক বিকৃতি ও জিঘাংসার অনিবার্য উত্তরাধিকার

ফ্যাসিজম একটি ইতিহাসবিদ্বেষী, দমনমূলক এবং বিদ্বেষপূর্ণ রাজনৈতিক দর্শন; যা কখনোই কোনো সঙ্গতিপূর্ণ বা রুচিশীল রাজনৈতিক চর্চা হতে পারে না। এটি মানবিক মর্যাদার অবমাননা করে, সহিষ্ণুতা ও বিরোধিতাকে পুরোপুরি নির্মূল করে এবং জনগণের মনোভাবকে একপেশে ও একঘেয়ে করে তোলে। ফ্যাসিজমের আঘাতে একটি সমাজের সাংস্কৃতিক এবং মানবিক পরিচয় ধ্বংস হয়ে যায়, যা শুধু রাজনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে।

তবে বর্তমানে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই এবং তার পরিণতি নিয়ে যে মতবিরোধ চলছে, তার মধ্যেও একটি মারাত্মক বিপদ রয়েছে- যতটা সহজে ফ্যাসিজম শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে, তার থেকে অনেক বেশি বিপজ্জনক তা ব্যবহারের নীতি। বিশেষত যখন সাংস্কৃতিক হেজিমনি বা কাউন্টার-হেজিমনি সম্পর্কে আলোচনা হয়, তখন এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যখন আমরা ‘থুতু নিক্ষেপ’ বা ‘জুতা মারা’ ইত্যাদি আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ডকে রাজনৈতিক প্রতিবাদ হিসেবে উপস্থাপন করি, তখন তা এক ধরনের সাংকেতিক সহিংসতায় রূপ নেয়, যা কোনো স্থায়ী এবং কার্যকরী পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যায় না।

ইতিহাস সামনে রেখে ফ্যাসিবাদের প্রতিষ্ঠাতারা যেমন তাদের প্রতীকী ব্যক্তি, ঘটনা ও বিষয়ের ওপর দেবত্ব আরোপ করে তথা সেগুলোকে ‘টোটেম’ হিসেবে দাঁড় করায়। তার বিপরীতে এর প্রতিবাদীরা সেগুলোর ওপর ক্রমগত আক্রমণের মধ্য দিয়ে নাই করে দিতে চেষ্টা চালায়। একটা পর্যায়ে সেই ‘টোটেম’ সম্পর্কিত প্রতিটি ব্যক্তি, বিষয় ও ঘটনাও হয়ে ওঠে নির্বিচার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন অনেক কোল্যাটেরাল ড্যামেজ ঘটে, অনেক নিরপরাধ প্রাণ হারান কিংবা আহত হন। ফ্যাসিবাদের কাউন্টার হেজিমনির শিকার হতে পারেন একইভাবে এমন কিছু ব্যক্তি যাদের আদতে ফ্যাসিজমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই।

গ্রামশির রাজনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রতিটি সংস্কৃতি রাজনৈতিক আধিপত্যের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এই আধিপত্যের বিপরীতে সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম, তা কখনোই বিক্ষোভ বা সহিংসতার মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে না। এটি যে যুক্তি, শিক্ষা, আর্কাইভ এবং শিল্পের মাধ্যমে কার্যকরী হতে পারে, সেটি গ্রামশির তত্ত্বের মূল বক্তব্য। ‘জুতো ছোড়া’ বা ‘গালি দেওয়া’ একে সিম্বোলিক ভায়োলেন্স বা সাংকেতিক সহিংসতার মধ্যে আবদ্ধ রাখে, যা দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক মুক্তির জন্য উপযুক্ত নয়। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই আক্রমণগুলো হয়ে উঠছে বিগত বছরগুলোর ভোট ডাকাতি, গুম, খুন আর রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো ধ্বংসের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি রাজনৈতিক বিকৃতির বিপরীতে জিঘাংসার এক অনিবার্য উত্তরাধিকার।

রাজনৈতিক ইতিহাসের অঙ্গ হিসেবে ফ্যাসিজমের মেমরি পলিটিক্স ও পার্টি মনোপলি একে অপরকে পরিপূরক করে, মানুষের মনোভাবকে বিভ্রান্ত করতে পারে। বিশেষত বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে ১৫ আগস্টকে একটি দলীয় স্মৃতিতে পরিণত করেছে, যা দেশের রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৫ আগস্টের স্মৃতি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, অথচ এটির প্রতি বৈধ সমালোচনাও রয়েছে। সম্প্রতি এই সমালোচনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ফ্যাসিবাদের অনেক প্রত্যক্ষ অংশীজনের পাশাপাশি কিছু সৃজনশীল ব্যক্তিকেও ‘কালচারাল ফ্যাসিস্ট’ বলে আক্রমণ করা হচ্ছে। এটাকে যুদ্ধের কোল্যাটেরাল ড্যামেজ হিসেবে ধরা যেতে পারে। কোনো অপরাধ না করেও কিছু মানুষের বিরুদ্ধে যে সহিংস মনোভাব প্রদর্শিত হচ্ছে, তা কখনোই মুক্তি বা সংস্কৃতির উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে না। বরং এটি নিজেই ফ্যাসিজমের মডেলে পরিণত হতে যাচ্ছে যা মূলত শাহবাগ মডেলের ‘মব কাচলার’ এবং ‘বিচারহীনতা’ থেকে সৃষ্ট জিঘাংসার অনিবার্য উত্তরাধিকার।

বিশেষ করে, বিগত ফ্যাসিস্ট শাসনামলে সর্বগ্রাসী ক্ষমতা খাটিয়ে শেখ মুজিবের শাসনকালকে (১৯৭২-১৯৭৫) যে ইউটোপিয়া হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল তার বিপরীতে যে রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে সেটার পরিণতিও খুবই বিপজ্জনক দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। ফ্যাসিস্ট ক্ষমতাবলয়ের অধীনে শেখ মুজিবের শাসনকালের দুর্ভিক্ষ, রক্ষীবাহিনী, দমননীতি নিয়ে যে বৈধ আলোচনা ছিল সেগুলাকে পুরোপুরি মুছে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে তাকে সরাসরি ইতিহাসের খল চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করে সরাসরি তাকে অপমানের ধারণা নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে যা আমাদের ইতিহাস থেকে যোজন যোজন দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

শেখ মুজিবকে দেবত্বের স্তরে তুলে ধরা অথবা তার শাসনকালকে একপেশে অপমান করা- দুটোই ঐতিহাসিকভাবে বিপজ্জনক। রাজনৈতিক ইতিহাসের যে কোনো চরিত্রের অবদান এবং ব্যর্থতা সমানভাবে মূল্যায়ন করা উচিত, তা না হলে জাতির সামনে সঠিক ইতিহাস উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। এখানে যে সমস্যাটি প্রকট, তা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি সংকীর্ণ, পক্ষপাতদুষ্ট বিতর্ক তৈরি হচ্ছে, যেখানে বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যে কোনো ঐতিহাসিক চরিত্রকে কেবল একটি মাপকাঠিতে রেখে বিচার করা, তার প্রকৃত অবদান বা ব্যর্থতা উপেক্ষা করা, এটি জাতির জন্য অতি বিপজ্জনক। শেখ মুজিবের শাসনকাল নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে ইতিহাসের প্রকৃত তথ্যকে গুরুত্ব দিতে হবে, কারণ এসব আলোচনার মধ্যে অনেকগুলো অতীতের রাজনৈতিক পরিচয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ক্ষমতা দখলের কৌশলও নিহিত রয়েছে।

অন্যদিকে যারা শেখ মুজিবকে দেবত্বের স্তরে তুলে ধরে, তাদের অনেকেই পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্বিনীত ফ্যাসিবাদী শাসনের সময় নানাবিধ রাজনৈতিক অপরাধে জড়িত ছিলেন। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, শাসনক্ষমতা অর্জিত হয়েছিল, এক ধরনের সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারকে সামনে রেখেই। তাই এসব সাংস্কৃতিক নির্মাণের মূলে যে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, তা উপেক্ষা করা যায় না। তারাও এক ধরনের আধিপত্যবাদী চিন্তাভাবনা থেকে বের হতে পারেননি। তাই তাদের আইডল তথা টোটেম হিসেবে শেখ মুজিবের উপস্থাপনকে সরাসরি সবাই আক্রমণের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে।

আওয়ামী ইতিহাস আরাধনা আর মুজিববন্দনার যে ধারা তার শেকড় অনেক গহিনে গ্রোথিত। তবে শাহবাগে শুরু হওয়া সাংস্কৃতিক বিভাজন এবং রাজনৈতিক অবক্ষয় রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর যে ক্ষতিসাধন করেছে তা জাতির সামনে এখন পরিষ্কার। যখন রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরা সাংস্কৃতিক সহিংসতা সৃষ্টি করেন, তখন এটি একটি গুরুতর সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে পরিচালিত করে। আর শাহবাগ আমাদের ঠিক সেদিকে নিয়ে গিয়েছিল।

পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে নতুন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক লড়াই যেহেতু চলছে, এখানে কোনোভাবেই নকল, আরোপিত কিংবা জিঘাংসার প্রতিফলন হিসেবে প্রাপ্ত ধারণাগুলোর বাস্তবায়ন করা যাবে না। প্রকৃতভাবে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে, আমাদের উচিত সত্যিকারের রাজনৈতিক নৈতিকতা এবং মানবিক শ্রদ্ধাবোধ প্রতিষ্ঠা করা। কোনো অশোভন আচরণ বা অপমানজনক কর্মকাণ্ড কখনোই পরিবর্তনের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। এ ক্ষেত্রে নতুন করে ফ্যাসিজম তার ডালপালা মেলে ধরার অবকাশ তৈরি করবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বিদ্যমান যে বিকৃতি ও জিঘাংসার অনিবার্য উত্তরাধিকার বারবার প্রকাশ হচ্ছে তার থেকে দূরে থাকাটাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।


ড. মো. আদনান আরিফ সালিম : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়