দূষণে দমবন্ধ ঢাকা
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় পাকিস্তানের লাহোর, ভারতের নয়াদিল্লি, বাহরাইনের মানামা ও কাতারের মতো শহরের সঙ্গে নাম উঠে এসেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকারও। ঋতুর পরিবর্তন হলেও ঢাকার বায়ুর মানের কোনো উন্নতিই ঘটছে না। শুধু বায়ুই নয়, শব্দ ও পানিদূষণেও তালিকার শীর্ষে রয়েছে এই নগরী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোটি মানুষ অধ্যুষিত ঢাকার বায়ু, শব্দ ও পানিদূষণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। তাদের মতে, দূষণ রোধে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রায় ৩০টির মতো প্রতিষ্ঠানের পৃথক আইন, নীতিমালা, কর্মপরিকল্পনা থাকলেও এর কোনো সুফল নেই। সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তায় প্রতিনিয়ত দূষণের কবলে পড়তে হচ্ছে ঢাকাবাসীকে। এমন অবস্থায় দম বন্ধ হয়ে আসছে এ নগরবাসীর; আক্রান্ত হচ্ছে নানা জটিল রোগ-ব্যাধিতে। প্রতিটি দূষণের কারণ ও প্রতিকার জানা থাকলেও কার্যকর উদ্যোগ নেই সংস্থাগুলোর। বরং বছরের পর বছর ধরে এক সংস্থা অন্য সংস্থার ওপর দায় চাপিয়ে দায়িত্ব সারছে।
ঢাকার বায়ু, পানি ও শব্দদূষণের প্রভাব সরাসরি পড়ছে জনস্বাস্থ্যের ওপর। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে হৃদরোগে যে পরিমাণ মানুষের মৃত্যু হয়, তার ২৫ শতাংশই বায়ু ও শব্দদূষণের কারণে ঘটে থাকে। তাই দূষণ রোধে সংস্থাগুলোর সুসংগঠিত সমন্বিত উদ্যোগের পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা।
বায়ুদূষণের উৎস্য : রাজধানী ঢাকায় বায়ুদূষণের উৎসগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফিটনেসবিহীন যানবাহন, ঢাকার চারদিকে হাজার খানেক ইটভাটা, সিটি করপোরেশন ও ব্যক্তি উদ্যোগের নির্মাণকাজ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানা, শহরের ভেতরে টোব্যাকো কারখানা, যত্রতত্র বর্জ্য পোড়ানো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অব্যবস্থা, তীব্র যানজট ইত্যাদি।
দূষণ সৃষ্টিতে ফিটনেসবিহীন যানবাহন ২৫ শতাংশ, সব ধরনের নির্মাণকাজ থেকে দূষণ সৃষ্টি হয় ২৬ শতাংশ, শিল্পকারখানা ও ইটভাটার ভূমিকা ২৬-২৭ শতাংশ, বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৭-৮ শতাংশ দূষণ হয়। গৃহস্থালির রান্না থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া থেকে দূষণ হয় ৬-৭ শতাংশ এবং অন্যান্য উৎস থেকে দূষণ হয় ৭ শতাংশ।
শব্দদূষণের উৎস : শব্দদূষণের প্রধান উৎস্য গাড়ির হর্ন। এ ছাড়া মাইক, সাউন্ড বক্সে উচ্চস্বরে গান বাজানো, রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে মাত্রাতিরিক্ত মাইক ব্যবহার, কলকারখানার উচ্চ শব্দ, নির্মাণ কাজ ইত্যাদি।
পানিদূষণের কারণ: অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ, পয়ঃবর্জ্য, ড্রেন অব্যবস্থাপনা, খাল-নালার দূষণ, গৃহস্থালির বর্জ্য, মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারসহ বিভিন্ন কারণে দূষিত হয়ে থাকে পানি।
বিশ্লেষকদের মতে, সব দূষণের সঙ্গেই মানুষ জড়িত। এসব দূষণ রোধে সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকা ওয়াসা, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ প্রায় ৩০টি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার আলাদা নীতিমালা, আইন ও উদ্যোগ এবং অর্থ বরাদ্দ রয়েছে। মাঝেমধ্যে ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান; ড্রেন, খাল নিয়ে সিটি করপোরেশনের হঠাৎ তৎপরতা দেখা গেলেও শব্দদূষণ রোধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়ে না।
আরও পড়ুন:
একে আবদুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ঢাকার দূষণ ও প্রতিকারের বিষয়ে জানতে চাইলে বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, দূষণের কারণ সব চিহ্নিত। বায়ুদূষণ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা মিলে ৩০টির মতো প্রতিষ্ঠান কাজ করে। প্রত্যেকের আলাদা বরাদ্দ, আলাদা নীতিমালা ও অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। সংস্থাগুলোর উদাসীনতায় বায়ুদূষণে দৃশ্যত কোনো পরিবর্তন নেই। বর্তমানে বর্ষাকাল তবুও বায়ুর মান দূষণের দিক দিয়ে শীর্ষে। এর অন্যতম কারণ সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা। যানজট নিয়ন্ত্রণেও এখন কোনো কাজ হচ্ছে না। যেখানে যত যানজট, তত বেশি দূষণ। যতক্ষণ গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবে, ততক্ষণ জ¦ালানি পুড়বে আর কালো ধোঁয়া বের হবে। এ ছাড়া এখনও উন্মুক্ত পরিবেশে বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে।
দূষণের প্রভাব: দূষণের ফলে পরিবেশের ওপর যেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, তেমনি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে জনস্বাস্থ্যের ওপরও। মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে, মেজাজ খিটমিটে হয়ে যাচ্ছে, বন্ধ্যত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, পারিবারিক কলহ বাড়ছে, হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে, ফুসফুস নষ্ট হচ্ছে, অ্যালার্জি-অ্যাজমা বাড়ছে, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ক্যানসারের মতো দূরারোগ্য রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম দূষিত বায়ুর নগরী। দূষিত শহরগুলোর তালিকায় শীর্ষ দিকেই থাকে ঢাকা। ঢাকার দূষণ জনজীবনকে নানাভাবে বিঘিœত করছে। তিনি বলেন, পৃথিবীতে যত মানুষ হৃদরোগে মারা যায়, তার ২৫ শতাংশ বায়ুদূষণের কারণে হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। বর্তমানে বাংলাদেশে শ^াসতন্ত্রীয় ও এলার্জি জাতীয় সমস্যা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০ জনে ৬ থেকে ৭ জন এলার্জি বা শ^াসতন্ত্রে ভুগছে। এ ছাড়া হাঁপানির টান, নিউমোনিয়া, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে দূষিত বায়ুর ধাতব কণা শিশুদের বর্ধন বা বৃদ্ধিতেও ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। শিশুদের মেধা ও মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। দূষিত বায়ু থেকে নির্গত ‘পিএম’ ফুসফুস দিয়ে রক্তে প্রবেশ করে মানুষের লিভার, পাকস্থলী ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বন্ধ্যত্ব নর-নারীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। বায়ুদূষণের কারণে মানুষের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কোনো না কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদদের মতে, ঢাকার দূষণ রোধে সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। শুধু সংস্থা বা মন্ত্রণালয় নয়, ঢাকাবাসীরও দূষণ রোধে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। দূষণ রোধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে এর প্রভাব দেশের অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য খাতেও মারাত্মকভাবে পড়বে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মেধাহীন ও খর্বাকৃতির হতে পারে বলে আশঙ্কাও প্রকাশ করছেন তারা।