গণ-অভ্যুত্থান : সংস্কৃতিকর্মীরা কোথা থেকে আসবেন

নাহিদ হাসান
১৮ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০
শেয়ার :
গণ-অভ্যুত্থান : সংস্কৃতিকর্মীরা কোথা থেকে আসবেন

ব্যাপকতম গণ-অভ্যুত্থান ঘটাল বাংলাদেশ। দেখল সারা দুনিয়া। চলছে বর্ষপূর্তি। এরই মধ্যে সমাজের একটা অংশ তাকে হেয় করার চেষ্টাও করছে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ ও রাজাকারদের পক্ষে খোদ রাজাকাররাও বলতে পারে না। কেন গণ-অভ্যুত্থানের বেলায় পারছে আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পারছে না, কেন?

কারণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সেই সাংস্কৃতিক লড়াইটা হয়েছে। যে লেখকরা পাকিস্তানের পক্ষে প্রাণপণে লিখে গেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পরে মুক্তিযুদ্ধের ম্যারাডোনা লেখকে পরিণত হয়েছেন তারা। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের পর একই যাত্রায় ভিন্ন ফল কেন?

গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নাটক-সিনেমা ও যাত্রাপালায় ঢেউ আসার কথা। উপজেলায় উপজেলায় নতুন নতুন নাটকের দল, নতুন নতুন সিনেমা হল, বুকশপ, বটতলা ও পুকুরপাড়ে সিমেন্টের চেয়ার-বেঞ্চ দিয়ে মঞ্চ গড়ে ওঠার কথা। বিপ্লবের পর পুরনো সংস্কৃতির জায়গায় নতুন সংস্কৃতি আসে। বিপ্লব বা অভ্যুত্থানকে স্থায়ী করতে দরকার হয় সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থান। কিন্তু তার বদলে মুজিববর্ষ স্টাইলে জুলাইবর্ষ পালন চলছে।

যারা এই সাংস্কৃতিক সংগ্রামটা করবেন, তারা লেখক-শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী। তারা কোথা থেকে আসবেন? তারা জন্ম নিয়েছেন গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে। গণ-অভ্যুত্থানের ভাষা, চেতনা, ইতিহাস থেকে আসবেন। আসবেন সমাজের দারিদ্র্য, সংকট, ভালোবাসা, প্রতিবাদ, বেদনা ও স্বপ্ন যেখানে মিশে থাকে, সেখান থেকে। মানুষের অভিজ্ঞতা ও কল্পনার রূপকার তারা।

লেখক, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মীদের একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। দীর্ঘদিন পড়াশোনার মধ্য দিয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে হয়। তেমনি শিল্পীদেরও। লেখক যে পড়াশোনা করবেন, তার জন্য চাই পাঠাগার, চাই লেখকদের আড্ডা। যিনি গান করেন, তার চাই গান শেখার ও পরিবেশনার পরিবেশ। মানে প্রতিষ্ঠান চাই।

২.

২৮ জুন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বক্তৃতায় বললেন, তিনি দেড় বছরে কয়েকটি কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করার তালিকা করেছেন। কিন্তু বক্তৃতায় বুঝলাম, সেটা হলো নববর্ষে ও ঈদে বাঙালির বদলে বাংলাদেশের সব জাতির ও ধর্মের মানুষের উৎসবে পরিণত করা, এই অংশগ্রহণটুকুই। এবং বাঙালির বদলে বাংলাদেশপন্থি বয়ান তৈরি করা।

এই বয়ান তৈরি করবে কারা? যারা করবে তারা গড়ে উঠবে কি মুখের কথায়? ইউটিউবারের ১৫ মিনিটের ভিডিওর মাধ্যমে? প্রতিষ্ঠান ও বিনিয়োগ ছাড়াই হবে? সবগুলো প্রশ্নের উত্তর ‘না’। দেশজুড়ে চর্চার পরিবেশ লাগবে। একটা অনুকূল আবহাওয়া লাগবে মাঠে, ক্লাসরুমে, বাসার উঠানে, গ্রামীণ মেলায়, শহরের চায়ের টেবিলে। কিন্তু তারা শিখবে কোথায়?

বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মহড়ার ঘর, হাটে-ঘাটে মঞ্চ কই? মাত্র ৩ মাসে প্রতিটি ইউনিয়নে রাষ্ট্রের এক টাকা খরচ ছাড়াই সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মহড়ার ঘর ও মঞ্চ নির্মাণ করা সম্ভব।

উপজেলাগুলোতে স্থানীয় বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাবে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের পক্ষে ইউএনও যদি ডেকে ঘোষণাটি দেনÑ দাতাদের নাম, ঠিকানা ও পরিমাণটি স্থাপনার পাথরফলকে লিখে রাখা হবে, দাতা হিসেবে এই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সম্মানের জন্য প্রতিটি পাড়া থেকে দাতা বের হয়ে আসবেন। বাংলাদেশ তো এভাবেই গড়ে উঠেছে। এটাই গণ-অভ্যুত্থানের সংস্কৃতি। ডিসিদের ঢাকায় ডেকে এই নির্দেশনা দেওয়া হোক, কালই দেশব্যাপী ঘর ও মঞ্চ নির্মাণের জোয়ার চলে আসবে। রাষ্ট্রের এক টাকাও খরচ হলো না, কিন্তু ঘর ও মঞ্চ নির্মাণের ঢেউ এলো।

প্রত্যেকটি পৌরসভার একাধিক মার্কেট আছে। একটি মার্কেটে বুকশপের জন্য ও সিনেপ্লেক্সের জন্য জায়গা বরাদ্দ বাধ্যতামূলক করা যায়। এই নির্দেশনাটুকু দিতেও এক টাকা খরচ হবে না। এই নির্দেশটুকু অভ্যুত্থানের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা এখনও দিতে পারেন।

সাংস্কৃতিক ও মানসিক পুনর্গঠনের জন্য গণমাধ্যমে আওয়ামী শাসনের ওপর চলচ্চিত্র, নাটক, ডকুমেন্টারি যারা বানাবে, তাদের গড়ে তোলার উদ্যোগ কই? সারাদেশের ৮টি বিভাগে তরুণ লেখক প্রকল্প চালুর উদ্যোগ কই? চলচ্চিত্র অনুদান নিয়ে কথা উঠেছে।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কালচারাল ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ১০/১২টি। কয়েকটিতে পরিচালক নিয়োগ করা হয়েছে। এটাই শেষ কথা? চিলমারীতে ভাওয়াইয়া একাডেমি প্রতিষ্ঠা কতদূর? এগুলোতে স্থানীয় লেখক ও শিল্পীদের যুক্ত করে ভাষা-সংস্কৃতি বিকাশে জোয়ার আনা যেত। অথচ চলছে গৎবাঁধা কাজ। জেলা-উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির কথা আর কাঁহাতক বলা যায়।

একপাল কবি, এক পাল শিল্পী, এক পাল সাহিত্যিক, এক পাল বুদ্ধিজীবী, এক পাল সাংবাদিক আর এক দঙ্গল শিক্ষক! সব গুম-খুন-লুটপাটের বৈধতা নির্মাণে দক্ষ ও পারদর্শী এমন পালে-দঙ্গলে সৃজনশীল মানুষ আর কোনো দখলদার শাসক পেয়েছিল বলে জানা যায় না।Ñ কথাগুলো ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি ফেসবুকে লিখেছিলেন রাখাল রাহা। এখন গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে ঝাঁকে ঝাঁকে কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষক লাগবে না?

তিন.

স্বাধীন চিন্তার পরিবেশ কই? কোথায় সেই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাÑ যেসব সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বা কাঠামোর মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজে মুক্তচিন্তার চর্চা গড়ে তোলা যায়।

প্রথম দরকার শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার। উদ্দীপনামূলক ও বিশ্লেষণমূলক শিক্ষা চালু করাÑ যেখানে মুখস্থের চেয়ে প্রশ্ন করা, বিশ্লেষণ করা ও নিজের মত গঠনের সুযোগ বেশি। পাঠ্যপুস্তকে বহুমতের ধারণা এবং বিতর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি স্থান দেওয়া। আর লাগবে শিক্ষকদের নিরপেক্ষতা ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা, যাতে তারা ছাত্রদের চিন্তার স্বাধীনতা দমন না করেন। গবেষকরা যে নতুন জ্ঞান উৎপাদন করবেন, তা প্রচার ও প্রকাশের ব্যবস্থা থাকতে হবে। তা যদি রাষ্ট্রের সঙ্গে, ধর্মের সঙ্গে, প্রতিষ্ঠিত চিন্তার সঙ্গে সাংঘর্ষিকও হয়, তবু।

দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যম ও তথ্যপ্রবাহের স্বাধীনতা লাগবে। সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবিধানিকভাবে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। নাগরিকদের সত্য, বিভ্রান্তি ও মতের পার্থক্য বোঝার জন্য গণমাধ্যম বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া।

তৃতীয়ত, আদালত ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে হতে হবে স্বাধীন চিন্তা ও মত প্রকাশের রক্ষাকবচ। ব্যক্তির মত প্রকাশে বাধা দিলে তার বিরুদ্ধে বিচারিক সুরক্ষা এবং রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ছাড়া মত প্রকাশের অধিকার আদালত দ্বারা রক্ষা করা।

চতুর্থত, থিয়েটার, সাহিত্যসভা, শিল্প প্রদর্শনী ইত্যাদির মাধ্যমে প্রশ্ন, মতভেদ ও চিন্তার চর্চা উৎসাহিত করা। সংস্কৃতিকেন্দ্র, পাঠাগার, শিল্প একাডেমি ইত্যাদিকে মুক্তচিন্তা ও বিতর্কের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়ে তোলা।

পঞ্চমত, রাজনৈতিক সহনশীলতা। রাজনৈতিক দলগুলোতে বহুমতের চর্চা ও মতভিন্নতার সহনশীলতা বাড়ানো। যে কোনো উপায়ে রাজনীতিতে বক্তৃতা, প্রতিবাদ, মিছিল ইত্যাদি মত প্রকাশের জায়গাগুলোকে রক্ষা করা।

মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যে শিল্পীরা পথে নামলেন, নাটক-কবিতা লেখার জন্য হাসিনার বিরুদ্ধে নামলেন যে অভিনেতা, নাট্যকার ও কবিরা; অভ্যুত্থান শেষে তারা দেখলেন, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম মানুষকে কাঁদতেও মানা করেছেন।


নাহিদ হাসান : লেখক ও সংগঠক