নারীর মৃত্যু নিবন্ধনেও পরিবারের অবহেলা
জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইনানুযায়ী মৃত ব্যক্তির তথ্য (নাম, বয়স, মৃত্যুস্থান, তারিখ) মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। আইনটি নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য হলেও বাস্তবতা হচ্ছে- নারীর মৃত্যুনিবন্ধনের হার দেশে আশঙ্কাজনকভাবে কম। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। নানা পদক্ষেপের কারণে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেক্টরে শিক্ষিত নারীরা পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে ও সফলতার মুখ দেখছে। এখন শহুরে নারী ও পুরুষের পাশাপাশি গ্রামীণ নারীরাও দেশের আর্থ-সামাজিক খাতে অবদান রেখে চলেছেন।
আমাদের দেশে কৃষি খাতের ২০টি কাজ রয়েছে। এরমধ্যে গ্রামীণ নারী ১৭টি কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে থাকেন। কৃষি খাতের ২০টি কাজের মধ্যে ১৭টি খাতে গ্রামীণ নারী সক্রিয় অংশগ্রহণ করলেও কৃষি খাতের ঋণ ও সরকারি সুযোগ-সুবিধাগুলো থেকেও গ্রামীণ নারী আজীবন বঞ্চিতই থেকে যান। এক গবেষণায় দেখা গেছে- দেশের মোট নারী শ্রমশক্তির পরিমাণ ১ কোটি ৭০ লাখ। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী, যারা ৬৮ শতাংশ কৃষি, পোলট্রি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া গ্রামীণ নারী গৃহকর্মী, উন্নয়নকাজের সহযোগী (ভবন তৈরির জোগালি নামে পরিচিত), ইট ভাঙার কাজ, পার্লারের কর্মী, স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠকর্মীসহ নানা ধরনের কর্মে নিয়োজিত থেকে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। স্বল্প মজুরিতে গ্রামীণ নারী তার সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করছেন।
আমাদের দেশে মোট কর্মজীবী নারীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এর মধ্যে দেড় কোটির ওপরে গ্রামীণ নারী। দেশে পোশাকশিল্প, কৃষিকাজ, কুটিরশিল্প, আসবাবপত্র তৈরি, ক্লিনিক ও হাসপাতালে নার্সসহ নানাবিধ কাজে গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদেশি রেমিট্যান্সেও গ্রামীণ নারীর অবদান কম নয়। গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের দেশের যত নারী প্রবাসে কর্মরত রয়েছেন তার ৭৯ শতাংশই গ্রামীণ। প্রবাসে চাকরিরত গ্রামীণ নারীর কষ্টার্জিত অর্থে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। আর গার্মেন্টস সেক্টর তো আমাদের দেশের অন্যতম একটি বৃহৎ শিল্প। এ শিল্পের প্রাণ হলো দেশের সাধারণ নিম্নবিত্ত নারীরা। একবিংশ শতাব্দীতে এসে কন্যাসন্তানের জন্ম নেওয়াকে পরিবার স্বাগত জানালেও দেশের অর্থনীতিতে তাদের অবদান থাকলেও সেই কন্যা যখন জীবন-মরণের সীমানা ছাড়িয়ে যায়; তখন পরিবার তার মৃত্যুনিবন্ধনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আগ্রহী হয় না, যার অর্থ- নারীর অধিকার রক্ষায় সমাজ-পরিবার আজও সচেতন নয়। যে নারী জীবিত অবস্থায় পরিবারকে পূর্ণতা দিয়েছেন; কিন্তু তার মৃত্যুর পর নিবন্ধনে পরিবারের থাকে ব্যাপক অনীহা। পরিবারের কাছে নারীর মৃত্যুনিবন্ধন যেন কোনো ম্যাটার নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব বলছে, দেশে পুরুষের মৃত্যুনিবন্ধন হচ্ছে ২৬ শতাংশ, নারীর ক্ষেত্রে তা ৫ শতাংশ। ২০২৩-২৪ সালে রংপুরে ২০ হাজার ২০২ নারীর মৃত্যু হয়েছিল। এর মধ্যে ৬ হাজার ৫৩৭ মৃত্যু বা ৩২ শতাংশ মৃত্যুর নিবন্ধন হয়েছিল।
নারীর মৃত্যুনিবন্ধন কম হওয়ার কারণসমূহ
ক. পরিবারের সদস্যরা নারীর জমি ও সম্পদ না থাকায় তার মৃত্যুনিবন্ধনের প্রয়োজন বোধ করেন না। শহরে আধুনিক সচেতন নারীরা সম্পত্তির মালিক হলেও গ্রামাঞ্চলে খুব কম নারী জমি বা সম্পত্তির মালিক। বাংলাদেশে জমি ও অন্যান্য সম্পদের মালিক মূলত পুরুষ। শহরে নারীর মৃত্যুনিবন্ধনের হার গ্রামাঞ্চলের তুলনায় বেশি। শহরে বসবাসকারী নারীদের অনেকেরই বাড়ি-ফ্ল্যাট-জমির মালিকানা আছে। আবার কর্মজীবী হিসেবে তাদের ব্যাংক হিসাবও রাখতে হয়। ফলে তাদের উত্তরাধিকারের বিষয়টি সামনে আসে আর মৃত্যুনিবন্ধন ছাড়া তা বাস্তবায়ন হওয়া সম্ভব নয়। গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ সম্পদের মালিকানা পুরুষের। উত্তরাধিকারসূত্রে নারী কোনো সম্পদের মালিক হলে পুরুষ আত্মীয়স্বজন তাদের কাছ থেকে লিখিয়ে নেওয়ার বহু উদাহরণ আছে। তাই তারা নারীর মৃত্যুনিবন্ধনের বিষয়ে আগ্রহ দেখান না। নারীর মৃত্যুনিবন্ধনে তাদের দায় নেই যেন।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের ছোবলে নারীর শ্রমবাজার
খ. মৃত্যুনিবন্ধন বিষয়ে মানুষের ধারণা বা সচেতনতা কম। অনেক পরিবারই মৃত্যুনিবন্ধন করা যে জরুরি, তা জানে না। তারা মনে করে, মৃত্যু হয়ে গেছে, করার আর কিছু নেই।
গ. প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাব, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের নারীদের ক্ষেত্রে। দেখা যায়, মৃত্যুনিবন্ধনের জন্য জন্মনিবন্ধন জরুরি। বেশির ভাগেরই জন্মনিবন্ধন করা নেই, তাই শেষমেশ মৃত্যুনিবন্ধনও করা হয় না।
ঘ. আইনি জটিলতা বা আর্থিক প্রয়োজন পড়লেই নারীর পরিবার বিলম্বে নিবন্ধন করায়।
ঙ. সরকারি দপ্তরগুলোর সমন্বয়হীনতা-দীর্ঘসূত্রতা, অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ আর্থিক লেনদেন।
আরও পড়ুন:
ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন মানবজাতি
করণীয়
১. নানাভাবে এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। ২. নিবন্ধনপ্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। ৩. নিবন্ধন অফিসগুলোতে কর্মরত জনবলের দক্ষতা ও গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী তাকে সার্ভিস দিতে হবে। ৪. চিকিৎসকরাও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন, যেমন- অনেক ক্ষেত্রে কোনো নারীর মৃত্যুর সময় সবচেয়ে কাছের ব্যক্তি থাকেন একজন চিকিৎসক। সুতরাং মৃত্যুনিবন্ধন হওয়ার ক্ষেত্রে তারও ভূমিকা থাকা দরকার। ৫. স্বাস্থ্যকর্মীরা মৃত্যুনিবন্ধন করার ব্যাপারে পরিবারগুলোকে তথ্য ও নির্দেশনা দিতে পারেন। ৬. মৃত্যুনিবন্ধন করার জন্য সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালানো। বর্তমানে সামাজিক যেসব মাধ্যম আছে, সেগুলোর প্রচারে জনগণ সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়।
মৃত্যুনিবন্ধন নারীর অধিকার। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, সমাজের চারপাশে তাকালে বোঝা যায়; সম্পত্তির উত্তরাধিকার বা ঋণ পরিশোধের বিষয় থাকলেই নারীর মৃত্যুনিবন্ধন দ্রুত হয়। নিবন্ধন অফিস বাড়ির কাছাকাছি হলে বা নিবন্ধন কার্যালয়ের সঙ্গে মৃত ব্যক্তির পরিবারের সম্পর্ক ভালো থাকলে মৃত্যুনিবন্ধন হয়। কোনো এলাকায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিশেষ কর্মসূচি হলে নিবন্ধন বেড়ে যায়। জন্মনিবন্ধন এবং সমাজকল্যাণ কর্মসূচির অভিজ্ঞতা আছে এমন পরিবারের নারীর মৃত্যুনিবন্ধন বেশি হতে দেখা যায়, এছাড়া পরিবার-সমাজ মৃত্যুনিবন্ধন আইনকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। পরিবার ও ভোগবাদী সমাজের কাছে আইন প্রতিপালনের চেয়ে আর্থিক স্বার্থ জড়িত না থাকলে নারীর মৃত্যুনিবন্ধনের গুরুত্ব তেমন একটা নেই বললেই চলে।
আমাদের মনে রাখতে হবে- একটি দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা নিরূপণ ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিতেও জন্মনিবন্ধনের পাশাপাশি মৃত্যুনিবন্ধন জরুরি। ফলে মৃত্যুনিবন্ধন কেবল সংখ্যা হিসেবে দেখলে চলবে না, এ বিষয়ে যেমন সচেতনতা তৈরি করতে হবে, তেমনি নিবন্ধনপ্রক্রিয়া সহজ ও সাশ্রয়ী করতে হবে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষ প্রত্যেক নাগরিকের জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নারীর মৃত্যুনিবন্ধন কেবল পরিসংখ্যানগত কোনো বিষয় নয়, এটি অধিকারের বিষয়। এটি একজন নারীর জীবনের শেষ সম্মান। পরিবারের মনে রাখা দরকার, নারীর মৃত্যুনিবন্ধন কেবল পরিসংখ্যানগত কোনো বিষয় নয়, এটি তার অধিকারের বিষয়।
আরও পড়ুন:
রহস্যে ঘেরা এক অসম যুদ্ধ!
মৌলি আজাদ : লেখক ও প্রাবন্ধিক