বান্দরবানের হৃৎপিণ্ডে বর্জ্যের পাহাড়
দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে ‘পর্যটন রানী’ হিসেবে পরিচিত বান্দরবান এখন বর্জ্যের দুর্গন্ধে দমবন্ধ হয়ে উঠছে। শহরের প্রাণকেন্দ্র মংক্যঘোনা প্রধান সড়কের দুপাশে প্রতিদিন ট্রাকভর্তি পচা আবর্জনা ফেলছে পৌরসভা। এতে শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি সৃষ্টি হচ্ছে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি।
পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে ৪০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয় শহরে। কিন্তু কয়েক দশক পেরিয়ে গেলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ফলে রাস্তার পাশে জমে থাকছে পচা সবজি, ফল, খাবারের অবশিষ্টাংশ, প্লাস্টিক ও পলিথিন। মাঝে মাঝে এসব বর্জ্যে আগুন লাগানো হয়, যা পরিবেশে বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে দেয়।
মংক্যঘোনার স্থানীয় বাসিন্দা বেলাল উদ্দিন দৈনিক আমাদের সময়কে বলেন, কয়েক দশক পেরিয়ে গেলেও বর্জ্য ফেলার জন্য উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করতে পারেনি বান্দরবান পৌরসভা। প্রতিদিন পৌরসভার একাধিক ট্রাক থেকে এখানে ফেলা হচ্ছে পচা সবজি, ফল, খাবারের অবশিষ্টাংশ, প্লাস্টিক ও পলিথিনসহ নানা বর্জ্য। এসব বর্জ্য রাস্তার দুপাশে স্তূপ আকারে জমে থাকে। কখনও কখনও পৌরসভা সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন পলিথিন পুড়ে পরিবেশ দুর্গন্ধময় হয়ে ওঠে।
সরেজমিন দেখা যায়, মংক্যঘোনার এই সড়ক হয়ে বান্দরবানে সরকারি স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় হাজার হাজার মানুষ আসা-যাওয়া করে। কলেজছাত্র রাতুল ইসলাম জানায়, পচা বর্জ্যরে দুর্গন্ধ এতটাই তীব্র যে, অনেকে নাক চেপে ধরে হেঁটে যায়। দুর্গন্ধের কারণে বমি বমি ভাব হয়।
পাহাড়ি এলাকায় বয়স্ক মানুষের সংখ্যাও কম নয়। বয়সজনিত কারণে অনেকের ফুসফুস ও শ্বাসনালি দুর্বল থাকে। রাস্তায় চলাফেরার সময় দুর্গন্ধ ও ধুলাবালিতে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। চিকিৎসকদের মতে, দূষিত বায়ু হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস ও অন্যান্য শ্বাসজনিত রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। শ্বাসকষ্ট রোগী অংশৈমং মারমা বলেন, আমি রোগী মানুষ, এ রাস্তা দিয়েই আমার যাওয়া-আসা।
আরও পড়ুন:
ডেমরায় এক কক্ষে কিশোরী ও যুবকের মরদেহ
বীর বাহাদুর উশৈসিং দুই যুগের বেশি সময় এমপি, মন্ত্রী ও উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি নিজের এলাকায় আবর্জনা ফেলার একটি জায়গাও ঠিক করে যাননি।
মংক্যঘোনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে হওয়ায় বান্দরবান শহরজুড়ে বাতাসে আবর্জনার দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। সবচেয়ে বিরক্ত হন পর্যটকরা। বান্দরবানে টং রিসোর্টসহ আশপাশের পাহাড় ও শঙ্খ নদী দেখতে এলে এই বর্জ্যরে স্তূপ পার হয়েই আসতে হয়। সিলেট থেকে বান্দরবান উপভোগ করতে আসা পর্যটকদের পক্ষে মাহমুদুল ইসলাম বলেন, রোয়াংছড়ি স্টেশনের ওপরে লেমুঝিরি রোডে প্রাকৃতিক বাতাস উপভোগ করব বলে আমরা পাহাড়ের উপরের দিকে উঠছিলাম; মংক্যঘোনা এলাকায় এসে আমরা পচা গন্ধ পাচ্ছিলাম, একটু সামনে গিয়ে দেখি আনুমানিক কয়েক হাজার টন বর্জ্য রাস্তার দুপাশে স্তূপ হয়ে আছে। এটা দেখে আমাদের পাহাড় উপভোগী করার মনমানসিকতা হঠাৎ কেটে যায়।
বান্দরবান সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী দৈনিক আমাদের সময়কে বলেন, খোলা জায়গায় পচা বর্জ্য রাখা হলে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও বিভিন্ন পরজীবী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এতে ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, ডেঙ্গু ও শ্বাসযন্ত্রের রোগ ছড়ানোর শঙ্কা বেড়ে যায়। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় তারা দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।
বান্দরবানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়, নদী, ঝরনা ও বাঙালি-পাহাড়ি সংস্কৃতি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। বান্দরবান হোটেল মোটেল মালিক মো. রমজান আলী একটি ডাম্পিং স্টেশনের দাবি জানিয়ে বলেন, প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের নেতারা চাইলে তা বাস্তবায়ন সম্ভব।
আরও পড়ুন:
আফরোজা পারভীন পেলেন অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার
পরিবেশবাদী স্থানীয় সাংবাদিক অংসিংনু মতে, পৌরসভার উচিত শহরের বাইরে নির্দিষ্ট ল্যান্ডফিল্ড এলাকা তৈরি করা, যেখানে বর্জ্য বিজ্ঞানসম্মতভাবে নিষ্পত্তি করা যাবে। পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন কম্পোস্টিং, রিসাইক্লিং ও ইনসিনারেশন ব্যবহার করা।
রাস্তার পাশে বর্জ্য ফেলার ব্যাপারে বান্দরবান পৌর প্রশাসক এসএম মনজুরুল হক বলেন, বর্জ্য ফেলা নিয়ে অনেকেই আমার কাছে অভিযোগ করেছেন। বর্জ্য ফেলা নির্দিষ্ট স্থান ও পানি নিরসনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে বান্দরবান পৌরসভা। দিনে দুপুরে কীভাবে বর্জ্যরে গাড়ি শহরের ভেতরে চলাচল করে, এ ব্যাপারে তিনি বলেন, খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেব।
বান্দরবান জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি বলেন, বান্দরবান জেলা পর্যটন কন্যা নামে সারাদেশে পরিচিত। এই শহরে নির্দিষ্ট বর্জ্য ফেলার স্থান থাকা উচিত। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা একটা প্রকল্প নেব।
আরও পড়ুন:
ডেঙ্গুতে একদিনে ৬ জনের মৃত্যু ভর্তি ৬৪৫